জুবায়ের আহমেদ, জাবি প্রতিনিধি:রেস্টুরেন্টে বসা নিয়ে মারামারিকে কেন্দ্র করে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) বটতলায় মহড়া দিয়েছে শাখা ছাত্রলীগের মীর মশাররফ হোসেন হলের নেতাকর্মীরা।
এসময় সংবাদ সংগ্রহকালে দুই সাংবাদিককে কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী কর্তৃক লাঞ্ছিতের ঘটনা ঘটে। বুধবার (২২ মার্চ) রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার ভাসানী চত্ত্বরে এই ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মীর মশাররফ হোসেন হলের এক শিক্ষার্থীকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের কিছু শিক্ষার্থী বুধবার সন্ধ্যায় বটতলায় মারধর করে। এই মারধরের প্রতিশোধ নিতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগ নেতাদের নির্দেশে একদল শিক্ষার্থী রামদা, লোহার পাইপ, কাচের বোতল সহ বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হল থেকে মহড়া দিয়ে বটতলার ভাসানী চত্ত্বরে আসে।
এসময় শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন পদধারী নেতার উপস্থিতিতে সংবাদ সংগ্রহকালে দা বাংলাদেশ টুডের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি জুবায়ের আহমেদ ও ডিবিসি নিউজের ক্যাম্পাস প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ আল মামুনের উপর চড়াও হয়ে মারধরের চেষ্টা করে হল ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী। বিক্ষিপ্তভাবে হামলা করে জুবায়ের আহমেদের পরনের শার্ট ছিঁড়ে ফেলা হয়। বটতলায় প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দাবি করেন, বুধবার সন্ধ্যায় বটতলায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসম্পাদক ও মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক ছাত্র আহমেদ গালিবকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের মাস্ক পরা একদল শিক্ষার্থী মারধর করেন। এর জের ধরেই তারা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের দিকে যাচ্ছিলেন।
এদিকে মীর মশাররফ হোসেন হলের শিক্ষার্থীদের অস্ত্রশস্ত্রসহ মহড়ার খবর পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব থেকেই অবস্থান নেয় প্রক্টরিয়াল টিম। শিক্ষার্থীরা বটতলার ভাসানী চত্ত্বরে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল অভিমুখে যাওয়ার চেষ্টা করলে প্রক্টরিয়াল টিম তাদের বাধা প্রদান করে। সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের মধ্যে ঘণ্টা ব্যাপী বাগবিতণ্ডা হয়।
এসময় শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের শিক্ষার্থী ও প্রক্টরকে উদ্দেশ্য করে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় স্লোগান ও গালাগাল দিতে থাকে। পরে সাংবাদিককে হেনস্থার ঘটনায় সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করলে হলের নেতাদের নির্দেশে বটতলা এলাকা ত্যাগ করে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা। যাওয়ার পথে নিচু বটতলার রাস্তাজুড়ে তাদের সাথে নিয়ে আসা কাচের বোতল ভাঙচুর করতে করতে তারা হলে ফিরে যায়।
এসময় ঘটনাস্থলে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হাসান মাহমুদ ফরিদ (পরিবেশ বিজ্ঞান-৪৪), সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান (ইতিহাস-৪৪), সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ (মার্কেটিং-৪৪), সহ-সভাপতি সজীব হোসেন(পরিবেশ বিজ্ঞান-৪৪), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. বিপ্লব হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক লেলিন মাহবুব(লোক প্রশাসন-৪৪) উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায় তাদের নির্দেশেই মারধরের প্রতিশোধ নিতে হল থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মহড়ায় বের হয় শিক্ষার্থীরা। এছাড়া তাদের ইন্ধনেই সাংবাদিকদের মারধরের চেষ্টা করে অন্য নেতাকর্মীরা।
প্রক্টরিয়াল টিমের সাথে বাকবিতণ্ডার সময়ে শাখা ছাত্রলীগের সহ সম্পাদক আহমেদ গালিবের হাতে রামদা, সহ সম্পাদক মৃন্ময় দাস, ৪৮ ব্যাচের ইংরেজি বিভাগের রাইয়ানুজ্জামান আকিব, গণিত বিভাগের ফয়সাল আমিন আলিফ আলফা, ৪৯ ব্যাচের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অনুপ সরকার দীপ, রসায়ন বিভাগের মাহমুদুল হাসান শান্ত, প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের প্রিন্স সহ প্রায় ২০ জন নেতাকর্মীর হাতে লোহার পাইপ ও কাচের বোতল দেখা যায়।
এসময় ৪৭ ব্যাচের জিওলজিক্যাল সাইন্সেস বিভাগের নাসির মুস্তাকিমকে সাংবাদিকদের ওপর হামলার সময় ‘ওরা সাংবাদিক, ধর!’ বলে উস্কানি দিতে শোনা যায়।
ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন। এসময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হাবিবুর রহমান লিটন বলেন, ‘আমরা সাংবাদিককে হামলার ঘটনার সম্পর্কে জানতাম না। জানলে আসতামই না এখানে। এই ঘটনার জন্য দু:খ প্রকাশ করছি।’
সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘আমি ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলাম। তাই ঘটনাস্থলে আসতে দেরি হয়েছে। ছাত্রলীগের কেউ দেশীয় অস্ত্রের মহড়া দিয়ে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ক্যাম্পাসে দেশীয় অস্ত্র থাকলে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তো একরকম শঙ্কা তৈরি হয়। আমরা এসবের বিরুদ্ধে রয়েছি। এক্ষেত্রে হল থেকে এসব নির্মূলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আমরা সর্বাত্মক সহায়তা করবো।’
এদিকে সাংবাদিকের উপর হামলার ঘটনায় বিচার চেয়ে ভুক্তভোগী সাংবাদিক জুবায়ের আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, ‘আমি সংবাদকর্মী হিসেবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলাম।
এক পর্যায়ে রাত সাড়ে আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি, মীর মশাররফ হোসেন হলের প্রভোস্ট, নিরাপত্তা কর্মীদের উপস্থিতিতে মীর মশাররফ হোসেন হলের একাধিক শিক্ষার্থী আমার ওপর ও আমার সহকর্মী ডিবিসি নিউজের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক আব্দুল্লাহ আল মামুনের ওপর লোহার পাইপ, রামদা নিয়ে অতর্কিতে হামলা চালায়।
এসময় তারা ভিডিও করতেছে, ‘ধর ওরে!’, ‘ঐযে সাংবাদিক, মার ওগোরে’ এধরনের কথা বলে। হামলার ফলে মামুন মুখমণ্ডলে ও শরীরে আঘাত প্রাপ্ত হয় এবং আমার শার্ট ছিড়ে যায়।’
অভিযোগপত্রে তিনি উল্লেখ করে বলেন, ‘তাদের কর্মকাণ্ড স্পষ্টতই ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮’ এর ধারা ৫ এর (গ), (ঘ) ও (ঢ) লঙ্ঘন করে।
প্রক্টরিয়াল বডির উপস্থিতিতে তারা হেলমেট পরে রামদা, রড, জিআই পাইপ, লাঠিসোটা নিয়ে বটতলায় অবস্থান নিয়ে অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ স্লোগান দেয় এমনকি একাধিকবার ‘প্রক্টরের মাথায় রড দিয়া একটা বাড়ি মারলেই সবকিছু সমাধান হয়ে যাবে’ বলে মন্তব্য করেন।’
এতে তিনি লেলিন মাহবুব, হাসান মাহমুদ ফরিদ, আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরানকে প্রত্যক্ষ মদদ দেয়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান বলেন, ‘আজকের ঘটনাটি অপ্রত্যাশিত। আমরা এই ধরনের ঘটনাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রেখে তদন্তের মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা নিই।
এক্ষেত্রেও সেটিই করা হবে। এর বাইরে কোন ধরনের অভিযোগ পেলে সেগুলোও খতিয়ে দেখা হবে। এরা কি করেছে তোমরাও দেখেছো। তোমরা নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যাও।’
গত রবিবার (১৯ মার্চ) সাভারের সুলতানস ডাইনে বসাকে কেন্দ্র করে বিরোধের জেরে রাত দশটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (আইবিএ-জেইউ) ৪৭তম ব্যাচের ও রবীন্দ্রনাথ হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমানকে মারধর করা হয়।
এ ঘটনায় বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী আহমেদ গালিব, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তানভীর ইসলাম, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সাব্বির হাসান সাগর ও খালিদ হাসানসহ অজ্ঞাত ৪০ জনের বিরুদ্ধে প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মাহফুজুর।
এরপর বুধবার সন্ধ্যায় আহমেদ গালিবের ওপর পাল্টা মারধরের জেরে রাতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ হল অভিমুখে বের হন মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
তাদের সঙ্গে হলটির নবীন শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয় বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এছাড়া মঙ্গলবার (২১ মার্চ) রাতে মীর মশাররফ হোসেন হলের গেস্টরুমে এক শিক্ষার্থীকে চড় মেরে কান ফাটিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
সেসময় গেস্টরুমে শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হাসান মাহমুদ ফরিদ (পরিবেশ বিজ্ঞান-৪৪), সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান (ইতিহাস-৪৪), সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ (মার্কেটিং-৪৪), সহ-সভাপতি শাহ পরান (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-৪৪), যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন (রসায়ন-৪৪), আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান (আন্তর্জাতিক সম্পর্ক-৪৫), উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আলরাজি সরকার (সরকার ও রাজনীতি-৪৫) উপস্থিত ছিলেন। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে ‘জাবিতে গেস্টরুমে থাপ্পড় মেরে কান ফাটিয়ে দেয়ার অভিযোগ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে’ শিরোনামে দা বাংলাদেশ টুডে অনলাইনে বুধবার (২২ মার্চ) একটি নিউজ করেন জুবায়ের আহমেদ।
উক্ত সংবাদ প্রকাশের ফলে তার ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মীর মশাররফ হোসেন হলের একাধিক শিক্ষার্থী।