বিশ্বঐতিহ্যে জশনে জুলুছ ও গাউছে জামান তৈয়্যব শাহ্ (র.); অপেক্ষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির
এস এম আকাশ, ব্যুরো প্রধান, চট্টগ্রাম: মহান আল্লাহ তায়ালা তাঁর সমস্ত সৃষ্টি জগৎকে সাজিয়েছেন শুধু মাত্র তাঁর প্রিয় প্রেরিত রাসুল (স.) ও জগতে ভালোবাসাকে সুসজ্জিত এবং তৃপ্তিময়ে অলংকৃত করার জন্য।
আর এই দুটোর পরিপূরক মাধ্যম হিসেবে ভূপৃষ্ঠে আল্লাহ তায়ালা আগমন ঘটান তাঁরই প্রিয় ও সমগ্র সৃষ্টির প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (স.) কে যাঁর আগাম হয়েছিল পবিত্র মক্কা শরীফে আর দিনটি ছিল আরবি মাসের ১২ রবিউল আউয়াল।
তাই ১২ রবিউল আউয়াল প্রিয় নবীজির আগমণী দিবস তথা ঈদে মিলাদুন নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিসেবে জাতির ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে দিনটি সমগ্র সৃষ্টির জন্য খুশি'র দিন।
এই খুশির ঈমানী ভাবধারার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ১৩৯৪ হিজরি,১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দ,আরবি মাসের ১২ রবিউল আউয়াল সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক রাজধানী ও বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কোরবানিগঞ্জের বলুয়ারদীঘি পাড়ের খানকাহ এ কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া হতে সর্বপ্রথম জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন নবী (স.) আত্মপ্রকাশ করে।
তরিকত্ব আকিদ্বা ও সুন্নীয়তের বলয় খ্যাত
বাংলাদেশে এমন একটি পরিশীলিত ও আকর্ষণীয় ইসলামি সংস্কৃতির যাত্রা শুরু করেছিলেন রাসুল (দ) এর ৩৯তম অধঃস্তন বংশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র,আধ্যাত্মিক ও জনপ্রিয় মানবিক সংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এশিয়া খ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়া (মাস্টার্স) মাদ্রাসার অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ও শতাধিক দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের জনক,কাদেরীয়া ত্বরিকার মহান দিকপাল গাউছে জামান আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ;) নির্দেশনা ও রুপরেখা অনুসারে।
আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রথম এই জশনে জুলুছে নেতৃত্ব দেন আঞ্জুমানের তৎকালীন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সিরিকোর্ট দরবারের খলিফা আলহাজ্ব নূর মোহাম্মদ আল কাদেরী (রহ;)।
১৯৭৬ খৃষ্টাব্দের ১৩৯৬ হিজরি সনে এর প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ (রহ;) জুলুছ উপলক্ষে বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং তিনি নিজেই এই জুলুছে নেতৃত্ব দেন। পরে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তিনি প্রতিবছর ৯ রবিউল আউয়াল রাজধানী ঢাকা এবং ১২ রবিউল আউয়াল বন্দর নগরী চট্টগ্রামে আয়োজিত জশনে জুলুসে নেতৃত্ব দেন।
তাঁর নেতৃত্বে এদেশে 'জশনে জুলুছ' লাভ করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও বিশ্বের অন্যতম মুসলিম গন মিছিল হিসেবে রুপান্তরিত হয়। ১৯৮৬ সনে এতে লাখ লাখ মানুষ যোগ দেয়া শুরু করে যেটি গোটা দেশজুড়ে আলোড়ন তৈরি করে এবং বিশ্ব জুড়ে এক মডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট আয়োজিত এই জশনে জুলুছ কে অনুসরণ করে বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান,মাদ্রাসা,খানকাহ,দরবার ও সংগঠন গুলো রবিউল আউয়াল মাসে বের করে আসছে দেশব্যাপী শত শত জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (স.)।
চলমান ২০২৩ সালে এবারে ১২ই রবিউল আউয়াল বাংলাদেশের পূর্ণভূমি ও পীর আউলিয়ার আধ্যাত্মিক ও সুফিবাদের জনপদ বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ও দেশের রাজধানী ঢাকায় ১৪৪৫ সনের জশনে জুলুছ হবে ৫১তম ঐতিহাসিক আয়োজন।
গোটা এই মহতি আয়োজন সেজেছে বর্ণাঢ্য এবং জনপ্রিয় মিছিল যা দেশের সরকারকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলমান,মুসল্লী তথা দল মত নির্বিশেষে এত বড় উপস্থিতি বিশ্বে বিরল ও অদ্বিতীয় তাই এই পর্যায়ে এসে বিশ্বের অন্যতম রাষ্ট্র গুলো এটিকে বিভিন্ন ভাবে স্বীকৃতি দিতে কুটনৈতিক পরিমন্ডলে যোগাযোগ করছে,ইতি মধ্যে বিশ্বের অন্যতম আচার্য বহুল ঘটনা,আবিষ্কার ও বিবিধ বিষয় কে স্বীকৃতি দানকারী রেকর্ড বুক "ওয়ার্ড বুক অব গিনেস" কর্তৃপক্ষ জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন নবী (স.) কে আমলে নিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিষয়টি কে বিবেচনায় নিয়েছে।
এছাড়াও মুসলিম দেশ গুলোর মধ্যে জুলুস নিয়ে ব্যাপকভাবে গবেষণা করা হচ্ছে, আরব লীগের অন্তর্ভুক্ত দেশ গুলো বাংলাদেশের এই জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন নবী কে তাদের প্লাটফর্মের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্মাননা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন বলে জানান ইন্দোনেশিয়া সরকারের পক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রতিনিধি ড.মারুফ আল কাকি ওয়াল নুরী ইবনে আব্দুল্লাহ্।
বাংলাদেশের সরকারও এ উপলক্ষে ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে সরকারি বেসরকারি ভবন এবং দেশে নিযুক্ত বিদেশের কুটনৈতিক মিশন গুলোতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের আদেশ জারি করে 'মিলাদ' অনুষ্ঠানকে আরো বেশি তাৎপর্যমন্ডিত এবং ব্যাপকতা দান করেছে।
আরব লীগের অন্তর্ভুক্ত বাইশটি দেশের মধ্যে বিশটি দেশেই সরকার কর্তৃক এ উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে আসছে তবে বিশ্বময় হয়ে আসা ঈদে মিলাদুন নবী উদযাপনের মধ্যে বাংলাদেশের "জশনে জুলুছ" হলো সর্বাধিক জনপ্রিয় তাৎপর্যপূর্ণ ও আন্তর্জাতিক খ্যাত।
আর এই জুলুস কে আরও প্রাণবন্ত ও বরকতময় করে তুলেছেন সৈয়্যদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ;) এর সুযোগ্য সাজ্জাদানশীন শাহজাদা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ যিনি বটবৃক্ষ হয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। ১৯৮৭ থেকে এ পর্যন্ত প্রায় সবকটি জশনে জুলুছে নেতৃত্ব দিয়েছেন হুজুর কেবলা তাহের শাহ্ (মা জি আ)।
তাঁর নেতৃত্বে আনজুমান ট্রাষ্টের এই ১২ রবিউল আউয়াল চট্টগ্রাম শহরে আয়োজিত জুলুছে বিগত বছর গুলোতে আনুমানিক প্রায় অর্ধকোটির কাছাকাছি মানুষের অংশগ্রহন হয়েছে বলে দেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।চট্টগ্রামের এই জশনে জুলুছ কে বিশ্বের সেরা জশনে জুলুছ হিসেবে আখ্যায়িত ও বিশ্বঐতিহ্য আখ্যা দিয়েছেন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
জশনে জুলুছ কি...?
মহান মহিমাময় আল্লাহ যিনি আমাদেরকে দান করেছেন অসংখ্য নেয়ামত। প্রধান নেয়ামত হিসেবে সর্বশেষ নবী খাতেমুল আম্বিয়া প্রিয় হাবীব হুজুর করিম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কে সৃজন করে ধন্য করেছেন সমস্ত সৃষ্টি জগতকে। যাঁর সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, ‘লাওলাকা লামা খালাকতুল আফলাক’।
অর্থাৎ (হে হাবীব ! আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে কিছুই সৃষ্টি করতাম না (হাদীসে কুদসী) আরও এরশাদ হয়েছে, ‘ওয়ামা আরসালনা-কা ইল্লা রহমাতাল্লিল আলামীন’ অর্থাৎ (হে প্রিয় হাবীব) আমি আপনাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত (কল্যাণ) করে পাঠিয়েছি (সুরা: আম্বিয়া:আয়াত-১০৭)।
শুধু তাই নয়, নির্দেশও দেয়া হয়েছে রহমত প্রাপ্তির জন্য ‘কুল বি-ফাদলিল্লাহি ওয়া বিরাহ্মাতিহী ফাবিযালিকা ফালইয়াফ্রাহু,হুয়া খাইরুম মিম্মা ইয়াজমাঊন’। অর্থাৎ "অনুগ্রহ ও করুণা প্রাপ্তির কারণে যেন তারা খুশী উদযাপন করে" সঞ্চয়কৃত সবকিছু হতে উত্তম (সুরা: ইউনুস : আয়াত-৫৮)। আল্লাহর উক্ত নির্দেশ পালনের লক্ষ্যে,আমরা রবিউল আউয়াল মাসে প্রিয় নবীর দুনিয়ায় শুভ আগমনকে স্মরণ করে জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করি।
কারণ,আমরা আল্লাহ পাকের নির্দেশকে মান্য করি এবং পবিত্র কোরআনকে বিশ্বাস করি ও নিশ্চতভাবে জানি যে,রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নেয়ামত।
এই দিনে শরীয়ত সম্মতভাবে খুশি উদযাপনে যে কোন জাঁক-জমকপূর্ণ কর্মসূচিই আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের এক উত্তম উসীলা। আর যে ইবাদতই সম্মিলিতভাবে (জামাত সহকারে) হয় সেটার ছওয়াবও বেশী।
একদিকে আল্লাহর মহান নেয়ামতের শোকরগুজারি, অপরদিকে সেটা আল্লাহর নির্দেশ "ওয়াযকুরু নিয়’মাতাল্লা-হি আলাইকুম” অর্থ (আমার প্রদত্ত নেয়ামতের স্মরণ তথা চর্চা করো) এরই যথার্থ প্রতিফলন (সুরা: আ-লি ইমরান: আয়াত-১০৩) হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর দরবারে দো’আ করেছিলেন, “আল্লাহুম্মা রাব্বানা আনযিল আলায়না মা ইদাতাম মিনাস্সামা-ই তাকুনু লানা ঈ-দান"(সুরা: মা-ইদাহ আয়াত: ১৪৪) এ আয়াত থেকে বুঝা গেলো যে, যেদিন আল্লাহ তা’আলার খাস রহমত নাযিল হয়,ঐ দিনকে ঈদের দিন হিসাবে উদযাপন করা, খুশি প্রকাশ করা,ইবাদত করা,আল্লাহর শোকর আদায় করা আল্লাহর নেক বান্দাদের কাজ।
এতে সন্দেহ নাই যে ১২ ই রবিউল আউয়াল বিশ্বকুল সরদার প্রিয় নবী সমস্ত বিশ্বের জন্য আল্লাহর সর্ববৃহৎ নি’মাত ও রহমত হিসাবে জন্মগ্রহণ। সুতরাং এদিনকে ঈদে মিলাদুন্নবী হিসেবে উদযাপন করা মুস্তাহাসান,মাহমুদ ও আল্লাহর মাকবুল বান্দাদের তরীকাহ্।
দেশের তরিকত্ব অনুসারী,সুন্নীয়তের মত পথ অবলম্বনকারী,সাধারণ মানুষ ও সুফি গবেষকরা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় জশনে জুলুছে করার দাবি জানাচ্ছে সরকারের কাছে। একই সাথে আঞ্জুমানে রাহমানির আহমাদিয়া সুন্নীয়া ট্রাস্ট ও গাউছিয়া কমিটি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় পরিষদের আহবান শরিয়তসম্মত উপায়ে জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে এবারের জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ প্রতিবারের ন্যায় এবারেও শরিক হয়ে দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি,মুক্তির উছিলা এবং মহামহিম আল্লাহ ও তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি অর্জন করুন।
লেখক;- সুফি গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক