সড়ক–রেল অবকাঠামো উন্নয়নের জেরে যাত্রী কমছে আকাশপথে
গত কয়েক বছরে দেশে সড়ক ও রেল অবকাঠামোর উন্নয়নের প্রভাব পড়েছে দেশের আকাশপথের যাত্রী সংখ্যায়। যাত্রীর অভাবে বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের দুটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর।
বেসরকারি এয়ারলাইনসগুলোর হিসাব বলছে, সম্প্রতি দেশের অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে যাত্রী কমেছে অন্তত ৩০ শতাংশ। যাত্রীর অভাবে এরই মধ্যে বরিশাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দিয়েছে বেসরকারি এয়ারলাইনস নভো এয়ার ও ইউএস বাংলা এয়ারলাইনস। বিমানবন্দরটিতে সপ্তাহে মাত্র তিনটি করে ফ্লাইট পরিচালনা করছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান।
কয়েক বছর আগেও যশোর বিমানবন্দর ছিল দেশের ব্যস্ত বিমানবন্দরগুলোর একটি। প্রতিদিন বিমানবন্দরটিতে ১২ থেকে ১৪টি ফ্লাইট ওঠানামা করত। এখন বিমানবন্দরটির ফ্লাইট সংখ্যা কমেছে প্রায় আগের দুই–তৃতীয়াংশ।
গত কয়েক বছরে উড়োজাহাজের জ্বালানি জেট ফুয়েল বা এভিয়েশন ফুয়েলের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এর প্রভাব পড়েছে ভাড়ায়। অতিরিক্ত খরচের কারণে আগে যারা সময় বাঁচাতে আকাশপথ বেছে নিতেন, তাঁদের অনেকে অন্য মাধ্যমগুলোতে ফিরে যাচ্ছেন। এতে আকাশপথে যাত্রীর সংখ্যায় প্রতি বছর যে প্রবৃদ্ধি হতো, তা হোঁচট খেয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে সড়ক ও রেলপথে বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন।
বরিশাল বিমানবন্দর কি বন্ধ হয়ে যাবেবরিশাল বিমানবন্দর কি বন্ধ হয়ে যাবে এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে এবং কক্সবাজার–খুলনায় সরাসরি ট্রেন চলাচল শুরু হওয়ায় কম খরচে এবং স্বচ্ছন্দেই চলাচল করা যাচ্ছে। এর প্রভাবই পড়েছে আকাশপথে।
যাত্রী সংখ্যা কমায় দুটি উড়োহাজাজ নেপালের ইয়েতি এয়ারলাইনসের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে নভো এয়ার। সংস্থাটি বলছে, যাত্রী সংখ্যা কমে যাওয়ায় এই দুটি উড়োজাহাজের উপযোগিতা আপাতত নেই। তাই বোঝা কমাতেই উড়োজাহাজ দুটি বিক্রি করা হচ্ছে।
এক সময়ে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করা এই এয়ারলাইনস এখন মনোযোগ দিচ্ছে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বৃদ্ধিতে। এর জন্য তারা অন্তত তিনটি এয়াবাস এ–৩২১ মডেলের উড়োজাহাজ কিনছে।
নভোএয়ারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, ‘অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীর পরিমাণ প্রায় ৩০ ভাগ কমেছে। ফলে আমাদের বহরে থাকা সাতটি উড়োজাহাজের মধ্যে দুটি আমরা ইয়েতি এয়ারলাইনসের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছি। অবশিষ্ট ৫টি উড়োজাহাজ দিয়ে অভ্যন্তরীণ গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে।’
দেশে বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের সংখ্যা সাতটি। নভোএয়ার ছাড়াও অভ্যন্তরীণ যাত্রীসেবা দেয় রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস এবং বেসরকারি ইউএস বাংলা এয়ার ও এয়ার অ্যাস্ট্রা।
বরিশাল রুটের পাশাপাশি যশোর রুটেও যাত্রী সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে কমেছে বলে জানিয়েছে আরেক বেসরকারি এয়ারলাইনস ইউএস বাংলা। এয়ারলাইনসটি বরিশালে তাদের ফ্লাইট স্থগিত করেছে। আর ফ্লাইট কমিয়েছে যশোরে।
সংস্থাটির জনসংযোগ ও বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে সবচেয়ে এফেক্টেড হয়েছে বরিশাল ও যশোর বিমানবন্দর। একসময় যেখানে যশোরে দৈনিক ৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হতো, এখন সেখানে দৈনিক দুটি ফ্লাইট চালানো হচ্ছে। যেহতু যাত্রী কমেছে, তাই ফ্লাইট কমেছে।’
যাত্রী কমায় উড়োজাহাজ বেচছে নভোএয়ার যাত্রী কমায় উড়োজাহাজ বেচছে নভোএয়ার অবশ্য সামগ্রিকভাবে আকাশপথে যাত্রী কমেছে—এ তথ্য মানতে নারাজ তিনি। কামরুল বলেন, ‘এই দুই গন্তব্যে ফ্লাইট কমেছে।
কিন্তু সৈয়দপুর, সিলেট ও কক্সবাজার রুটে কিন্তু যাত্রী চাহিদা বেড়েছে। গত নভেম্বরে নির্বাচনের কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। কিন্তু ডিসেম্বর বা জানুয়ারির হিসাব যদি বলি, যাত্রী বেশ ভালো।’ অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির কারণে টিকিটের দাম বৃদ্ধিকেও যাত্রী কমে যাওয়ার কারণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, ‘বরিশাল বিমানবন্দর এখন প্রায় বন্ধ। যশোরে যাত্রী সংখ্যা কমেছে। ট্রেন চালুর পর কক্সবাজারেও কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তবে কক্সবাজার ব্যতিক্রম এ জন্য যে, এই বিমানবন্দরটি শুধু পর্যটকনির্ভর নয়। এখানে এনজিওগুলোর অনেক কর্মকাণ্ড আছে। পাশাপাশি অনেক অর্থনৈতিক স্থাপনা রয়েছে। ফলে এটার চাহিদা থাকবে।’
কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, ‘মানুষ এখন অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা অস্বস্তিতে আছে। ফলে স্বভাবতই আকাশপথে যাত্রী কমেছে। যেহতু নির্বাচন শেষ হয়েছে, আশা করা যায়, অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে। ফলে এই খাতে আবারও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে।’
তবে বরিশাল বিমানবন্দরের ক্ষেত্রে এতটা আশাবাদী নয় এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা। মূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে—ঢাকা বাদে অন্য বিমানবন্দরগুলোর সাথে এর তেমন সংযোগ না থাকা। অবশ্য বরিশাল বিমানবন্দরের যাত্রাটাও ওই অর্থে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চালুর লক্ষ্য নিয়ে হয়নি।
আকাশ থেকে শস্যক্ষেতে কীটনাশক ছিটাতে ১৯৬৩ সালে বরিশালের বাবুগঞ্জের রহমতপুর ইউনিয়নে নির্মাণ করা হয় প্রায় ২ হাজার ফুটের রানওয়ে। সে সময় এটিকে প্ল্যান্ট প্রোটেকশন বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
১৯৮৫ সালে এই রানওয়েটিকে বিমানবন্দরে রূপ দেওয়া হয়, তবে সে সময় এখানে বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ চলাচল শুরু হয়নি। ১৯৯৫ সালের ১৭ জুলাই বেসরকারি এয়ারলাইনস অ্যারো বেঙ্গলের ঢাকা-বরিশাল রুটে প্রথম ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে বিমানবন্দরটির বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়। ওই বছরেরই নভেম্বর মাসে বিমানবন্দরটিতে ফ্লাইট চালু করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস।
শুরু থেকেই এ পথে যাত্রীর খরা ছিল। ২০০৬ সালে যাত্রীর অভাবে বিমানবন্দরটিতে বাণিজ্যিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ৯ বছর পর ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল আবার এই বিমানবন্দরে ফ্লাইট শুরু হয়। বর্তমানে ১৬০ দশমিক ৫ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত বিমানবন্দরটির রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬ হাজার ফুট, আর প্রস্থ ১০০ ফুট।
ঢাকা বাদ দিয়ে দেশের অন্য বিমানবন্দরগুলোর সঙ্গে বরিশালের সংযোগ স্থাপন না করলে বরিশাল বিমানবন্দরটির ভবিষ্যৎ দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বিমানবন্দরটির বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য এর বহুমুখী ব্যবহারের ওপর জোর দিচ্ছেন।
কাজী ওয়াহেদুল আলম বলেন, ‘এটিকে অন্যভাবে ব্যবহার করতে হবে। যেমন এখানে স্টল এয়ারক্রাফট যেগুলো ২০–৩০ আসনের—এমন উড়োজাহাজ চালালে লাভজনক হতে পারে। সরকারকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। পাশাপাশি, ফ্লাইং একাডেমিগুলোকে যদি এই বিমানবন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে এর উপযোগিতা থাকবে।’