গাজা এখন ধ্বংস, মৃত্যু আর অনাহারের প্রতিচ্ছবি
ইসরায়েলের টানা প্রায় চার মাসের ধ্বংসাত্মক হামলায় একসময়ের প্রাণবন্ত জনাকীর্ণ ফিলিস্তিনি জনপদ গাজা এখন ধ্বংস, মৃত্যু আর অনাহারের প্রতিচ্ছবি। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান আর কামানের গোলার নিরন্তর আঘাতের পাশাপাশি স্থানীয় ফিলিস্তিনিদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে চরম ক্ষুধা আর রোগব্যাধি। এলাকাটিতে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় নিয়ে বারবার সতর্ক করে আসছে বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘ।
ইসরায়েলি হামলার কারণে গাজা উপত্যকার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৮৫ শতাংশের বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
তবে ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণে কোথাও নিরাপদ জায়গা নেই। বোমাবর্ষণের ঝুঁকি নিয়েই বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে গাদাগাদি করে থাকছে মানুষ। উত্তর গাজার ধ্বংসযজ্ঞ সম্পন্ন করার পর দক্ষিণে মনোযোগ দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেদিকে ক্রমেই হামলার মাত্রা বেড়ে চলেছে। গতকাল শুক্রবার বহু লোককে খান ইউনিস শহর ছেড়ে উপকূলের পথ ধরে সরে যেতে দেখা যায়।
গাজার বিভিন্ন অঞ্চলের বহু বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই না পেয়ে পথেঘাটে-প্রান্তরে পলিথিন দিয়ে ছাউনি বানিয়ে কোনো মতে সেখানে থাকছে। শীতকাল আসায় তাদের দুর্ভোগ চরমে। ঝড়-বৃষ্টি, খাবার, পানি ও ওষুধের তীব্র সংকট, রোগবালাইয়ের বিস্তার সব মিলিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে গাজাবাসী।
জাতিসংঘ বলছে, উপত্যকার প্রায় ৬০ শতাংশ বাড়িই ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি ১০টি স্কুলের ৯টির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। গাজার প্রায় সব হাসপাতাল অকেজো হয়ে পড়েছে।
জাতিসংঘ বলছে, ইসরায়েলি হামলা ও হামাসের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে গাজায় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা চরমে উঠেছে। অবরুদ্ধ উপত্যকাটির বাসিন্দারা বিভিন্ন মাত্রায় অনাহারের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
সেখানে পূর্ণমাত্রায় দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্মবিষয়ক সংস্থা সম্প্রতি জানায়, গাজার পাঁচ লাখ ৭০ হাজার মানুষ ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধা’য় কাতর।
গত অক্টোবরে ইসরায়েলি প্রতিশোধমূলক হামলা শুরুর কয়েক দিন পর থেকেই গাজায় খাবার, জ্বালানি ও ওষুধের সরবরাহ আটকে দেয় ইসরায়েল। অধিবাসীদের দুর্গতি চরমে ওঠার পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত গাজায় সীমিতভাবে ত্রাণসামগ্রী সরবরাহের অনুমতি দেয় তারা। তখন থেকে দুটি সীমান্তক্রসিং দিয়ে ধীরগতিতে গাজায় কিছু ত্রাণসামগ্রী পৌঁছাতে থাকে। তবে মানবিক সংস্থাগুলো এর পরিমাণ চাহিদার তুলনায় খুবই কম বলে সতর্ক করে আসছে।
যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে ঠাণ্ডা আর বৃষ্টিতে গাজার সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়েছে। জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, ঠাণ্ডা আর বৃষ্টিবাদলের আবহাওয়া প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজাকে সম্পূর্ণভাবে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে।
ইসরায়েলের অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডটির জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়ের প্রধান অজিত সাংঘে জানান, গাজার বৃষ্টি আর শীতের পরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে তারা খুবই উদ্বিগ্ন। অজিত সাংঘে জানান, যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে বহু মানুষ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে বাস করছে।
এর মধ্যে শীত আর বৃষ্টি গাজাকে পুরোপুরি বসবাসের অযোগ্য করে তোলার ঝুঁকিতে ফেলেছে। গাজার বেশির ভাগ মানুষের কাছে মোটা কাপড় বা কম্বল নেই। তাঁবু ও অস্থায়ী ছাউনিতে থাকা মানুষ অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে।
নিহতের সংখ্যা ২৬ হাজার ছাড়াল
গাজায় চার মাস ধরে চলা হামলায় এ পর্যন্ত ২৬ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল স্থানীয় সময় সকালে জানায়, ইসরায়েলি অভিযানে তখন পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ১৮৩ জন নিহত এবং ৩৭৭ জন আহত হয়। মন্ত্রণালয় জানায়, চলমান সংঘাতে গতকাল পর্যন্ত ২৬ হাজার ৮৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৬৪ হাজার ৪৮৭ জন আহত হয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী দক্ষিণ গাজায় বিশেষ করে খান ইউনিসে এখন জোরালো অভিযান চালাচ্ছে। এই শহরটিতে হামাসের শক্ত ঘাঁটি আছে বলে মনে করে ইসরায়েল। জাতিসংঘের কর্মকর্তারা গতকাল খান ইউনিসের আল আকসা, নাসের আল আমাল ও আল খায়ের হাসপাতালের আশপাশে প্রচণ্ড লড়াইয়ের খবর দিয়েছে। বহু মানুষকে গতকাল খান ইউনিস ছেড়ে যেতে দেখা যায়। সূত্র : আলজাজিরা, বিবিসি