মশা না মেরে শীতের জন্য অপেক্ষা
দেশে ডেঙ্গু এখন অপ্রতিরোধ্য। তারপরও মশা মারার কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেই। মশা মারার দায়িত্ব যে বিভাগ ও প্রশাসনের তারা এখন হাত গুটিয়ে বসে আছেন। আর শীতের অপেক্ষা করছেন। মনে করছেন, শীত আসলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমভিত্তিক রোগ নয়। সারা বছরই ডেঙ্গু থাকবে। এটা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হলো মশা মারা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাও একই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
কিন্তু তারপরও ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যক্রম এখনো পর্যন্ত নিম্নমানের। এ কারণে দেশের নাগরিকদের পাশাপাশি বিদেশিরাও রেহাই পাচ্ছেন না। বাংলাদেশে ভ্রমণে আসার পর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে কোরীয় এক পর্যটকের মৃত্যু হয়েছে।
গত ২৪ আগস্ট চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান বলে দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। এতে অস্বস্তিতে রয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, মশা না মারার বিষয়টি খুবই লজ্জাজনক। শুধু মশা মারলেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু সেই কাজের কাজটি করা হচ্ছে না। রাজধানীর ১১টি রেড জোন ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সেখানেও মশা মারা হয়নি।
রাজধানীর ১২৯টি ওয়ার্ডেই এখন মশার অবাধ বিতরণ লক্ষ্য করা গেছে। মশা মারার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগের খামখেয়ালিপনার কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ক্ষেত্রে রাজধানীতে রোগীদের এক ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে, আবার গ্রামের রোগীদের আরেক ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ কারণে রোগীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন।
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। বর্তমানে গ্রাম থেকে রোগীরা চিকিৎসা নিতে রাজধানীমুখে আসছে। ততোক্ষণে রোগীর শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়েও বাঁচানো যাচ্ছে না। বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগী শক সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: স্পেনে প্রবল বন্যা, রাজধানীসহ ৪ এলাকায় জরুরি অবস্থা জারি
দেশের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার শেষ ভরসাস্থল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের। কারণ দুর্ঘটনায় আহত/জখম, আগুনে দগ্ধ, জটিল ও দূরারোগ্যসহ নানা রোগে আক্রান্ত যেকোনো রোগী এই হাসপাতালে পৌঁছতে পারলে চিকিৎসা সেবা পাবেনই-এমনটা মনে করেন। আর তাই সারাদেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে প্রতিদিন বহু রোগী ছুটে আসেন এই হাসপাতালে। এই হাসপাতালেও ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আর সিট খালি নেই।
সিড়ি ও বারান্দায় রেখেও রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। ডেঙ্গু অনেক রোগীর রক্তক্ষরণ হয়। তাদের এমআরআই করতে হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের এমআরআই মেশিনটি সাত মাস ধরে নষ্ট রয়েছে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগকে জানানো হয়েছে। কিন্তু মেশিন ঠিক করা কিংবা নতুন মেশিন ক্রয়ের কোন নির্দেশনা আসেনি। স্বাস্থ্য বিভাগ যে কত অসচেতন তার জ্বলন্ত প্রমাণ এটি।
শুধু ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নয়, সারাদেশের হাসপাতালগুলোর একই অবস্থা। অনেক জায়গায় মেশিন নষ্ট। জনবলের অভাবে ব্যবহার না করায় কোথাও কোথাও মেশিন বাক্সবন্দি অবস্থায় রয়েছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেরানীরাও এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের এক শ্রেণীর কর্মকর্তাদেরও শুধু খাই খাই ভাব। তারা শুধু কেনাকাটা, বদলি, নিয়োগ ও নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়ার ধান্ধায় ব্যস্ত থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দুই হাত দিয়ে দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা সেবার জন্য বড় বড় অবকাঠামো ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু এইগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের, তারা সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। তাদের অবহেলার কারণে যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামো নষ্ট হওয়ার পথে।
স্বাস্থ্য বিভাগের দুষ্টু চক্রের কারণে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হওয়ার উপক্রম। বিশ্বে যে সকল দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়েছিল, সেই সকল দেশে বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে যা যা করার দরকার তাই করেছে।
তার সফলও হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা করা হচ্ছে না। ডেঙ্গু রোগীদের স্বজনরা বলেন, এখন আর আমাদের কোন আস্থা নেই। কারণ ডেঙ্গুর যে প্রাদুর্ভাব তা থেকে সৃষ্টিকর্তার উপর আমাদের একমাত্র ভরসা। মশা না মারার কারণে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, চাপ বাড়ছে ডাক্তার-নার্সসহ হাসপাতালের কর্মচারীদের। তারাও চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এমিরেটস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা পরিবর্তন করতে হবে। কারণ গ্রাম অঞ্চলে এক ধরনের, ঢাকায় আরেক ধরনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
এতে রোগীরা আস্থা পাচ্ছেন না। তাই চিকিৎসকদের বসেই ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। গ্রামের সব রোগী ঢাকায় চলে আসতেছে। প্রোটোকল অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে পারলে গ্রামের রোগীদের গ্রামে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব। জটিলতা নিয়ে ঢাকায় এসে অনেক রোগী মারা যায়। অথচ শুরুতে চিকিৎসা দিলে তারা ভালো হয়ে যেত যায়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ বলেন, বায়ু দূষণসহ ঢাকা বসবাসের দিক থেকে আন্তর্জাতিক রেটিং অনুযায়ী সর্বনিম্ন। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রেও সর্বনিম্ন মানের দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মশা মারার ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ এখনো হাত গুটিয়ে বসে আছে। তাদের যেন কোন লজ্জা-শরম নেই। সময় থাকতে মশা মারার পরামর্শ দেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে মশা মারতে হবে। এটি একটি চিহ্নিত শত্রু। তারপরও আমরা মশা মারতে পারছি না কেন? অনেকে শীত আসলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে ভেবে হাত গুটিয়ে বসে আছে।
কিন্তু মনে রাখতে হবে ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ। এখন থেকে মশা না মারলে রোগী বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থার সৃষ্টি হবে, হাসপাতালে আর জায়গা পাওয়া যাবে না, তখন অনেকে সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে।
এদিকে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে ৬৩৪ জন মারা গেলেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে নতুন ভর্তি রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ৬০৮ জন।
আক্রান্তদের মধ্যে ৮৯২ জন ঢাকার। এক হাজার ৭১৬ জন অন্যান্য বিভাগের। স্বাস্থ্য অধিদফতর আরও জানিয়েছে, সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে আট হাজার ৮৪৫ জন রোগী ভর্তি আছেন।
এরমধ্যে ঢাকাতেই তিন হাজার ৯২৮ জন। বাকি চার হাজার ৯১৭ জন ঢাকার বাইরে অন্যান্য বিভাগে। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত এক লাখ ৩০ হাজার ৩০২ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ছাড়া পেয়েছেন এক লাখ ২০ হাজার ৮২৩ জন।