শামসুল হক ভূঁইয়া, গাজীপুর প্রতিনিধি: টঙ্গীতে ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমার সা’দ অনুসারিদের তাবলীগের ছয় উসুলের মৌলিক বিষয়ের উপর শনিবার দ্বিতীয় দিন বাদ ফজর বয়ানের মাধ্যমে হয়েছে।
বাদ ফজর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইয়াকুব জিলানী। তার বয়ান অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা মনির বিন ইউসুফ।
ইজতেমাস্থলে মুরুব্বীদের বয়ান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পুরো ইজতেমাস্থলে নেমে আসে পিন পতন নীরবতা। গভীর মনোযোগ দিয়ে মুসল্লিরা মুরুব্বীদের বয়ান শুনছেন। পুরো টঙ্গী এলাকা যেন এখন ধর্মীয় নগরীতে পরিণত হয়েছে।
রোববার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে কুয়াশা-শীতকে উপেক্ষা করে শনিবার দিনভর মুসল্লিদের দলে দলে তুরাগতীরের ইজতেমায় আসা অব্যাহত রয়েছে। রোববার আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মুসল্লিদের এ আগমন অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন ইজতেমা কর্তৃপক্ষ।
এদিকে শুক্রবার থেকেই ইজতেমা ময়দান মুসল্লিদের পদচারনায় পুরো ভরে গেছে। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত মুসল্লি ও ঢাকাসহ আশপাশের লোকজন আসতে অব্যাহত থাকবে।
রোববার সকাল সাড়ে ৯ টা থেকে সাড়ে ১১টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
রোববারের বয়ান ও আখেরি মোনাজাত
রোববার বাদ ফজর ভারতের মাওলানা বাংলাদেশী মুরসালিন, হেদায়তী বয়ান করবেন মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর বড় ছেলে ভারতের মাওলানা ইউসুফ বিন সা’দ কান্ধলভী, তার বাংলায় তরজমা করবেন মাওলানা জিয়া বিন কাসিম।
এরপর আখেরি মোনাজাতও পরিচালনা করবেন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী।
রোববার দুপুরের আগেই আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমেই শেষ হবে এবারের বিশ্ব ইজতেমা।
শনিবার বয়ানকারীদের নাম
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন শনিবার বাদ ফজর ভারতের মাওলানা ইয়াকুবের বয়ান বাংলায় তরজমা করবেন মাওলানা মুনির বিন ইউসুফ, বাদ জোহর বয়ান করেন তুর্কির মাওলনা ওমর, বাদ আছর বয়ান মাওলানা ইলিয়াস বিন সা’দ কান্ধলভী, তার বয়ান বাংলায় তরজমা করেন মাওলানা ওসামা ইসলাম এবং বাদ মাগরিব ভারতের মাওলানা আব্দুস সাত্তার, তার বয়ান তরজমা করবেন মাওলানা জিয়া বিন কাসিম।
এবারও যৌতুকবিহীন বিয়ে
যৌতুকবিহীন বিয়ে বিশ্ব ইজতেমার একটি অন্যতম আকর্ষণ। প্রথম পর্বের ন্যায় এ পর্বেও বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন শনিবার বাদ আছর যৌতুকবিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়।
ভারতের মাওলানা সা’দ কান্ধলভীর ছোট ছেলে মাওলানা ইলিয়াস বিন সা’দ কান্ধলভী ওই বিয়ে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
এর আগে বয়ান মঞ্চ থেকে তিনি এ সংক্রান্ত বয়ানও করেন।
বিশ্ব ইজতেমার মিডিয়া সমন্বয়ক মোহাম্মদ আবু সায়েম বলেন, বিদেশী মুসুল্লীদের প্যান্ডেলের পাশে থাকা দোয়া মঞ্চে যৌতুক বিহীন বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এদিন সকাল থেকেই বর-কনের নাম তালিকাভুক্তি শুরু হয়। বিয়ের আগ পর্যন্ত চলে ওই তালিকাভুক্তি হওয়ার কাজ। যৌতুক বিহীন বিয়ের ওই মঞ্চের সামনে কণের অনুপস্থিতে তার স্বজন এবং বর ও তার স্বজনদের উপস্থিতে ইসলামী শরীয়ত অনুয়ায়ি যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন করা হয়। বিয়ের পর মঞ্চের সামনে ও আশে-পাশে থাকা মুসল্লিদের মধ্যে খেজুর ছুড়ে দেয়া হয়।
এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বেও শতাধিক যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
বিদেশিদের পদচারণে মুখর ইজতেমা মাঠ
সাদ কান্ধলভির অনুসারীদের মিডিয়া সমন্বয়ক মো. সায়েমের দেয়া তথ্যে জানা গেছে, শনিবার দুপুর পর্যন্ত বিশ্বের ৬১টি দেশ থেকে ৭ হাজার ৭২৫ জন বিদেশি মুসল্লি ইজতেমা ময়দানে বিদেশী কামরায় এসেছেন।
এসব দেশের মধ্যে রয়েছে জর্ডান, লিবিয়া, আফ্রিকা, লেবানন, আফগানিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইরাক,ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, মালদ্বীপ, নেপাল, জিবুতিসহ নানা দেশ।
তাঁদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে ইজতেমা আয়োজকদের পক্ষ থেকে। তাঁদের সার্বক্ষণিক খেদমতে রাখা হয়েছে বাংলাদেশি মুসল্লি।
প্রতিবছরের মতো এবারও অসংখ্য বিদেশি মেহমান আসছেন। রোববার মোজাজাতে আগ পযর্ন্ত আরও অসংখ্য বিদেশি মুসল্লি আসবেন বলে তিনি জানান।
দুই দিনে ৫ মুসল্লির মৃত্যু
বিশ্ব ইজতেমার সমন্বয়ক মোহাম্মদ আবু সায়েম জানান, গত দুইদিনে বিশ্বইজতেমা ময়দানে ৫ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।
শুক্রবার বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত যাদের মৃত্যু হয়েছে তারা হলেন- শুক্রবার এশার নামাজের সময় জিকির করার সময় হঠাৎ অচেতন হয়ে মারা যান ইজতেমায় যোগ দিতে আসা পূর্ব জুরাইন এলাকার মুসল্লি আব্দুল হান্নান (৪৫), একই রাত ১১টার সময় ইজতেমা ময়দানে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বঙ্গবাজার এলাকার ব্যবসায়ী মোঃ বোরহান (৪৮)।
এর আগে একইদিন সন্ধ্যায় গাইবান্ধার শুকুর মন্ডলের ছেলে আব্দুল হামিদ মন্ডল (৫৫) ও ঢাকার সাভারের বাসিন্দা আব্দুল আলীমের ছেলে মফিজুল ইসলাম (৫৪) এবং বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে ইজতেমা ময়দানে বরগুনার আব্দুল আলীর ছেলে মফিজুল ইসলাম (৭৫) বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে মারা গেছেন।
এ নিয়ে দ্বিতীয় দফার ইজতেমা আসা পাঁচ মুসল্লির মৃত্যু হলো।
তাশকিলের কামরা
ইজতেমা প্যান্ডেলের উত্তর-পশ্চিমে তাশকিলের কামরা স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি খিত্তায় তাশকিলের জন্য বিশেষ স্থান রাখা হয়েছে।
বিভিন্ন মেয়াদে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে ইচ্ছুকরা নাম তালিকাভুক্ত কওে সেখানে অবস্থান করছেন।
কাকরাইলের মসজিদের মুরব্বিদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন এলাকায় দ্বীনের মেহনতে পাঠানো হবে।
ফ্রি চিকিৎসা সেবা
ইজতেমায় আগত দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লিদের চিকিৎসাসেবা দিতে ময়দানে রয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ইজতেমায় আগত মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে ১২ টি মেডিকেল ডিম, ৬টি বিশেষায়িত মেডিকেল টিম, একটি কন্ট্রোল রুম, একটি স্বাস্থ্য শিক্ষা টিম, রেডিওলজি, প্যাথলজি, ফার্মাসিস্ট টিম ও ১১টি স্যানেটারি ইন্সপেক্টর টিম গঠন করা হয়েছে।
এসব টিমে ১২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ৫১ জন চিকিৎসক, চারজন ডেন্টাল সার্জনসহ কর্মকর্তা কর্মচারী মিলে ১৯৬ জন কাজ করছে।
এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার মুসল্লিকে স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছে।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে, হামদাদ, টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ি কল্যাণ সমিতি, ইবনেসিনা, র্যাব, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশন,মনসুর আলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,আঞ্জুমান মফিদুল।
নিরাপত্তা ও যান চলাচল
আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে পুলিশের পক্ষ থেকে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম জানান, শনিবার মধ্যরাত থেকে মোনাজাত শেষে রোববার বিকাল পর্যন্ত ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের মিরেরবাজার থেকে স্টেশন রোড পর্যন্ত, কামারপাড়া থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত এবং বিমানবন্দও থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকবে।
তিনি বলেন, ইজতেমা ময়দানসহ আশপাশ এলাকা কড়া নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে। প্যান্ডেলের ভেতর ও বাইরে মুসল্লিবেশে রয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পর্যাপ্ত সদস্য।
এছাড়া প্রায় ১০ হাজার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পুরো ইজতেমা ময়দানকে নিরাপত্তা চাদরে ঢেকে রেখেছে।
বিশেষ ট্রেন
টঙ্গীর রেলওয়ে স্টেশনের কর্মকর্তা জানান, আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে রেলওয়ে আখাউড়া, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে।
মোনাজাতের আগে ও পরে সব ট্রেন টঙ্গী স্টেশনে যাত্রাবিরতি করবে।
ইজতেমায় আগত যাত্রীদের কথা বিবেচনায় রেখে টঙ্গী রেলওয়ে জংশনে অতিরিক্ত টয়লেট ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।