ইসলামে তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি

তালাক ইসলামে একটি অপছন্দনীয় জায়েজ বিষয়। তালাকের বিধান না থাকলে নারীরা বা পুরুষেরা জুলুমের শিকার হত, এই হিকমতে তা বৈধ রাখা হয়েছে, অপপ্রয়োগ করার জন্য নয়। প্রশ্নে উল্লেখিত ‘তোমাকে তালাক দিলাম’ বললে এক তালাক রজয়ি পতিত হবে। অর্থাৎ এ কথা বলার পরও লোকটি পুনরায় ঘর-সংসার করতে চাইলে ইদ্দতের মধ্যে ‘রাজাআত’ করতে পারবেন। মানে স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবেন।
অতএব ‘তোমাকে তালাক দিলাম’ এ কথা বলার পরও স্বামী যদি চান তার স্ত্রীকে নতুন বিয়ে ছাড়াই ইদ্দতের মধ্যে বোঝাপড়ার মাধ্যমে ফিরিয়ে নিতে পারবেন। (বাদায়েউস সানায়ে: ৩/১৬৩; আলমুহিতুল বুরহানি: ৪/৪৩১; আলবাহরুর রায়েক: ৩/৩০০, ২৩৫; ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া: ১/৩৭৯; আদ্দুররুল মুখতার: ৩/৩৯৭; ইমদাদুল আহকাম: ২/৪৪৩)
ইসলামে তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি: ইসলাম পবিত্র সম্পর্ক রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করার তাগিদ দেয়। একেবারে অনন্যোপায় হলে বা তালাক দেওয়াটা কল্যাণকর হলেই কেবল তালাকের অনুমতি দেয়। তাতেও রয়েছে সুন্দর পরামর্শ। কোরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী তালাক দেওয়ার সর্বোত্তম ও সুন্দর পদ্ধতি হলো— স্ত্রী যখন হায়েজ (মাসিক) থেকে পবিত্র হবে, তখন স্বামী তার সঙ্গে সহবাস না করে সুস্পষ্ট শব্দে এক তালাক দেবে। যেমন—‘আমি তোমাকে তালাক দিলাম’। এরপর স্বামী যদি স্ত্রীকে ইদ্দত চলাকালীন ফিরিয়ে নিতে চায়, তাহলে তা পারবে। পুনরায় সম্পর্ক কায়েম করতে না চাইলে স্ত্রীর ইদ্দত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যাবে। তখন স্ত্রী ইচ্ছা করলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে। ইদ্দতের সময় হলো—গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত, আর গর্ভবতী না হলে তিন হায়েজ (মাসিক) অতিক্রম হওয়া পর্যন্ত। এ বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তালাকপ্রাপ্ত নারী তিন ঋতুস্রাব পর্যন্ত নিজেদের বিরত রাখবে’ (সুরা বাকারা: ২২৮)। আর ‘গর্ভবতীদের সময়কাল হলো- সন্তান প্রসব করা।’ (সুরা তালাক: ৪)
সঠিক পদ্ধতিতে তালাক দেওয়ার সুফল: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তালাকের পরে দাম্পত্যজীবনের সুখ-শান্তির কথা মনে পড়ে পরস্পরের গুণ ও অবদান স্মরণ করে উভয়েই অনুতপ্ত হয় এবং বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করার চেষ্টা করে। যদি শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী এক তালাক দেওয়া হয়, তাহলে এ আশা পূরণ হওয়ার সুযোগ থাকে এবং পুনরায় বৈবাহিক জীবন শুরু করতে পারে। অর্থাৎ এ পদ্ধতিতে তালাক দিলে প্রথমত স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণের অবকাশ পাওয়া যায়। আর যদি ইদ্দত শেষ হয়ে বিচ্ছেদও সম্পন্ন হয়, তবুও আবার তারা দাম্পত্যজীবনে ফিরে আসতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে নতুন মোহরানা ধার্য করে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, দ্বিতীয়বারও তাদের মাঝে বনিবনা না হলে এবং পুনরায় তালাকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেক্ষেত্রেও ইসলামের নির্দেশনার পূর্ণ অনুসরণ করে ওই সুবিধা ভোগ করতে পারবে।
তবে, দ্বিতীয় বার তালাকের পর স্বামীকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, খুব হিসাব-নিকাশ করে চলতে হবে। কেননা এখন শুধু একটি তালাক তার অধিকারে আছে। সারাজীবনের জন্য শুধুমাত্র একটি তালাক। কোনো কারণে আরেকবার তালাক দিলেই আর স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না এবং পুনরায় বিয়েও করতে পারবে না, বরং সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যাবে। কেননা এই সুযোগ দুই তালাক পর্যন্তই সীমিত করে দিয়েছে শরিয়ত।
সঠিক পদ্ধতি না মানার কুফল: অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ শরিয়তের উল্লেখিত সুন্দর পদ্ধতি মানে না। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সব শ্রেণির লোকদের মধ্যেই একটি প্রবণতা দেখা যায় যে তারা যখন রাগে-ক্ষোভে লিখিত বা মৌখিকভাবে তালাক দেয় তখন একসঙ্গে তিন তালাকই দিয়ে থাকে। তিন তালাক দিলে ইদ্দত চলাকালীনও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না এবং ইদ্দতের পরেও নতুনভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে না। একে অন্যের জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যায়। এমতাবস্থায় আপসের জন্য আগ্রহী হলেও তা কাজে আসে না।
একসাথে তিন তালাক দেওয়ার বিধান: একসঙ্গে তিন তালাক দেওয়া ইসলামি শরিয়তে নিকৃষ্ট ও হারাম বিষয়। আল্লাহ তাআলা এর শাস্তি হিসেবে এই বিধান দিয়েছেন যে, তারা পুনরায় একসাথে বসবাস করতে চাইলে স্ত্রীর ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর অন্যত্র তার বিয়ে হওয়া এবং পরবর্তী স্বামীর সঙ্গে তার মিলন হওয়া অপরিহার্য। এরপর কোনো কারণে সে তালাকপ্রাপ্তা হলে কিংবা ওই স্বামীর মৃত্যু হলে ইদ্দত পালনের পর এরা দুজন নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। (সুরা বাকারা: ২৩০)
কেউ যদি একসঙ্গে তিন তালাক দেয়, তাহলে তিন তালাকই পতিত হবে। অর্থাৎ স্বাম-স্ত্রী পরস্পরের জন্য হারাম হয়ে যাবে। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, একব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিলো। অতঃপর ওই মহিলা অন্যজনকে বিবাহ করলে সেও তাকে তালাক দিয়ে দেয়। রাসুলুল্লাহ (স.)-এর কাছে জিজ্ঞেস করা হলো, সেকি প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন, ‘না। যতক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী প্রথমজনের মতো ওই মহিলার মধু আস্বাদন না করবে’, অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত দ্বিতীয় স্বামী তার সাথে সহবাস না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে প্রথম স্বামীর জন্য হালাল হবে না। (সহিহ বুখারি: ৫২৬১)
এ হাদিসের ব্যাপারে বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাকার হাফেজ ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘এটা রিফাআ বিন ওয়াহাবের ঘটনা- যে তার স্ত্রীকে একসাথে তিন তালাক দিয়েছিলো..।’ (ফাতহুল বারি: ৯/৫৮১)
কেউ কেউ মনে করেন যে একসাথে তিন তালাক দিলে এক তালাকই হয়। এর উত্তরে হাফেজ ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘জেনে রাখো! কোনো সাহাবা, কোনো তাবেয়ি ও সালফে সালেহিনের মধ্যে যাদের কথা হালাল-হারাম ও ফতোয়ার ব্যাপারে গ্রহণযোগ্য হয়, তাদের কারো থেকে এ ধরনের সুস্পষ্ট কথা বর্ণিত হয়নি যে, স্বামী তার স্ত্রীর সাথে মিলিত হওয়ার পর একসাথে তিন তালাক দিলে এক তালাক ধরা হবে’। (ইলাউস সুনান: ৭/৭১০)
রাগ বা ঠাট্টাচ্ছলেও তালাক নয়। মনে রাখতে হবে, ‘রাগের অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায়’ (আদ্দুররুল মুখতার: ৪/৪৫২)। ইবনু হাজার আসকালানি (রহ) বলেন, ‘সাধারণত মানুষ রাগান্বিত হয়েই তালাক দেয়।’ (ফাতহুল বারি: ১০/৪৮৯)
এমনকি হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘তিন জিনিস ঠাট্টা করে করলেও পতিত হয়ে যায়। বিবাহ, তালাক ও ‘তালাকে রজয়ি’ ফেরত নেওয়া।’ (আবু দাউদ: ২১৯৪)
আসলে ইসলামে তালাক খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এ কারণেই বিয়ের আগে তালাকের মাসয়ালা ভালোভাবে জেনে নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন আলেমরা। অবশ্য কেউ যদি প্রচণ্ড রেগে যায় ও রাগের ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আর এ অবস্থায় সে কী বলেছে কিছুই মনে না থাকে তাহলে ওই অবস্থার তালাক কার্যকর হবে না।
অনেকের ধারণা, তালাকের সময় সাক্ষী না থাকলে তালাক পতিত হয় না। এটি মনগড়া কথা। সাক্ষীর প্রয়োজন হয় বিয়ের সময়। তালাকের জন্য এক বা একাধিক কোনো সাক্ষীরই প্রয়োজন নেই।
তালাকের মাসয়ালা না জানা ব্যক্তিদের জন্য ‘তালাক’ শব্দ উচ্চারণ করাও ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আগেভাগেই আলেমদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত। কারণ বাস্তবেই যদি বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় এরপরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একসঙ্গে বাস করার অর্থ হলো- তারা ব্যভিচারে লিপ্ত। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মানার তাওফিক দান করুন। শরিয়তের সুন্দর পরামর্শগুলো গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।