নেপালে বাম জোটের প্রত্যাবর্তন আঞ্চলিক শক্তির গতি পরিবর্তন করবে
তৃতীয়বারের মতো নেপালে ফিরেছে বাম জোট সরকার। মাওবাদী নেতৃত্বাধীন সরকার নেপালি কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং তার প্রাক্তন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনিফাইড মার্কসবাদী লেনিনবাদী) বা সিপিএন-ইউএমএল-এর সাথে জোট করেছে।
জোটে যোগদানকারী অন্য দুটি দল হলো মধ্যদেশভিত্তিক জনতা সমাজবাদী পার্টি এবং নতুন আত্মপ্রকাশকারী স্বতন্ত্র পার্টি। ২০২২ সালের নভেম্বরে জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের পর এটি নেপালে গঠিত তৃতীয় জোট সরকার হবে।
নেপালের ১৫ বছরের গণতান্ত্রিক স্বল্প-মেয়াদী সরকারের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে বর্তমান পুনর্বিন্যাস কোন আশ্চর্যের বিষয় নয়। মাওবাদীরা যদি আগামী মাস বা বছরগুলিতে নেপালি কংগ্রেসের সাথে আবার ফিরে আসে তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ক্ষমতা ভাগাভাগি, রাজনৈতিক অসন্তোষ, মতাদর্শগত পার্থক্য, দুর্বল কর্মক্ষমতা, এবং নেপালকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চাপ- একটি দীর্ঘ তালিকা মাওবাদীদের নেপালি কংগ্রেসের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করেছিল।
যদিও নেপালি কংগ্রেস আশা করেছিল মাওবাদী নেতা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, পুষ্প কমল দাহাল ( প্রচন্ড নামেও পরিচিত) জোট ত্যাগ করবেন, কিন্তু রাতারাতি এই পরিবর্তন আশা করেনি। ক্ষমতা ভাগাভাগি অতীতে বাম জোটের পক্ষে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দাহাল এবং সিপিএন-ইউএমএল প্রধান তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কে.পি. শর্মা অলি, উভয়ই শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব যারা এর আগে 'কে প্রধানমন্ত্রীর পদ দখল করবে' তা নিয়ে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। এই ধরনের মতপার্থক্য মাওবাদী এবং সিপিএন-ইউএমএল-এর একীভূতকরণের মাধ্যমে গঠিত একটি স্বল্পকালীন ঐক্য পার্টির বিলুপ্তি ঘটায়।
তার উচ্চাকাঙ্ক্ষার ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে অলি আবারও প্রধানমন্ত্রীর পদে লড়বেন বলে জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে।
সিপিএন-ইউএমএল জোটের মধ্যে বিধানসভা আসনের সবচেয়ে বেশি অংশ ধারণ করে–মাওবাদীদের হাতে আছে ৩২ টি, সিপিএন-ইউএমএল -এর হাতে আছে ৭৬টি আসন) – অলি সম্ভাব্যভাবে এই সুবিধাটি কৌশল হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন ।
মাওবাদী এবং সিপিএন-ইউএমএল অন্তত ছয় মাস ধরে তাদের জোট পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আলোচনা করছে। বর্তমান মুহূর্তে দুটি বামপন্থী দল আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের মতপার্থক্য মেটাতে কি ভূমিকা নিয়েছে ?
দাহাল নেপালি কংগ্রেসের চেয়ারম্যান, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবাকে জানিয়েছিলেন যে, বহিরাগত চাপ তাকে সিপিএন-ইউএমএল-এর সাথে হাত মেলাতে এবং একটি নতুন সরকার গঠন করতে বাধ্য করেছে।
যদি এই দাবিটি সত্য হয়, তাহলে চীন নেপালে বামপন্থী দলগুলির সাথে জোট গঠনের দিকে ঝুঁকতে পারে । এই ধারণাটি চীনের অতীত প্রচেষ্টার আলোকে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে, যেমন ২০২০ সালে অলি এবং দাহালের মধ্যে দ্বন্দ্বের মধ্যস্থতা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা।
অন্যদিকে, ভারত নেপালি কংগ্রেস এবং মাওবাদীদের সাথে একটি মোলায়েম সম্পর্ক উপভোগ করেছে। মাওবাদীরা নয়াদিল্লির কাছে একটি চ্যালেঞ্জিং দল ছিল, ২০০৮ সালে দাহাল প্রথম প্রধানমন্ত্রীর আসন লাভ করার পর উভয়ে একসঙ্গে কাজ করার জন্য অনেক দূর এগিয়েছে।
যাইহোক, সিপিএন-ইউএমএল উত্তরের প্রতিবেশী চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা বলেছে; বেইজিং তাদের মতাদর্শগত প্রয়োজনীয়তা এবং তাদের অতি-জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি উভয়ের সাথেই মানিয়ে নিতে পারে - যা মূলত ভারতবিরোধী।
চীন এবং ভারতের মধ্যে হিমালয়ে উদ্ভূত তীব্র ভূ-কৌশলগত দ্বন্দ্বের মধ্যে, নেপাল বেইজিং এবং নয়াদিল্লি উভয়ের জন্য একটি প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। চীন তার তিব্বত অঞ্চলের সাথে নেপালের বিস্তৃত সীমান্তকে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখে, এটি বেইজিংকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এর অধীনে কাঠমান্ডুর সাথে তার সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা জোরদার করতে প্ররোচিত করে।
বিপরীতভাবে, এই অঞ্চলে কৌশলগত স্বার্থকে মাথায় রেখে ভারত নেপালের সাথে তার দীর্ঘস্থায়ী "বিশেষ সম্পর্ক" বজায় রাখতে চায় । ২০১৭ সালে দাহালের নেতৃত্বে নেপালী সরকারকে সফলভাবে বিআরআই-তে যোগদানের জন্য প্ররোচিত করার পর চীন নেপালে তার প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে।
চুক্তিটি বেইজিংয়ের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক বিজয় এবং নয়াদিল্লির জন্য একটি ধাক্কা। তবে বিআরআইকে ঘিরে গত আট বছরে আলোচনা সত্ত্বেও, এর বাস্তবায়নে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। বাম জোটের প্রত্যাবর্তন একটি স্থবির বিআরআই-তে পুনরুজ্জীবন ঘটাতে পারে।
বেইজিং নেপালে মালদ্বীপের মতো কূটনৈতিক খেলা খেলতে চায়, যেখানে ভারত বর্তমানে অসুবিধার মধ্যে আছে। চীন নেপালের সাথে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তির বিষয়ে আলোচনা প্রসারিত করতে চাইবে, যেটি নেপালে তিব্বতি শরণার্থীদের "মুক্ত তিব্বত" আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের ইচ্ছার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে । ইতিমধ্যে, ভারত দুটি মূল কারণে বাম জোটের সাথে জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রথমত, গত কয়েক বছরে নেপাল ও ভারতের মধ্যে 'শক্তি বাণিজ্য' গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
ভারত কঠোরভাবে নেপালে তার নিজস্ব বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্রয় করে, চীনা উৎপাদিত কোনো শক্তি তারা প্রত্যাখ্যান করে। সিপিএন-ইউএমএল এখন সরকারে থাকায়, নেপাল ভারতের সাথে তার বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে 'পাওয়ার বাণিজ্যের' সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এই ব্যবস্থায় পরিবর্তন চাইতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ভারত সম্প্রতি বিলুপ্ত মাওবাদী-কংগ্রেস জোটের সাথে যে মসৃণ সহযোগিতা উপভোগ করেছিল তা হারাবে। সরকারের বিলুপ্তির সময়, নেপালি কংগ্রেস ভারতের সাথে একটি অনুকূল সমীকরণ গড়ে তুলেছে।
গত মাসেই নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন.পি. সৌদ নবম রাইসিনা সংলাপের জন্য ভারত সফর করেছিলেন, তার প্রতিপক্ষ এস জয়শঙ্কর সহ শীর্ষ ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে সংলাপে মিলিত হন । বাম জোট নিয়ে ভারতের উদ্বেগ দেখা দিলে, নেপাল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে অংশীদারিত্বে পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র নেপালের একটি উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সহযোগী।
বিশেষ করে মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন (এমসিসি) প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি হতে পারে।অভ্যন্তরীণ এবং চীনা বিরোধিতার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, নেপালি সংসদ অবশেষে পাঁচ বছরের বিলম্বের পরে, ২০২২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের এমসিসি অনুদান পেতে সক্ষম হয়। বিআরআই-এর বিরুদ্ধে চীন এমসিসিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের একটি উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে । তাই বেইজিং নেপালে প্রভাব বাড়াতে ঋণ ও ভর্তুকি বাড়ানোর লক্ষ্য রেখেছে ।
শেষে বলতে হয় , নেপালের বাম জোটের পুনরুত্থান ক্ষমতার গতিশীলতার পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, যা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে । চীনের প্রভাব বৃদ্ধির সাথে সাথে নেপালের পররাষ্ট্রনীতি ভারতের স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করে বেইজিংয়ের দিকে ঝুঁকতে পারে। এই পরিবর্তন ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে, বিশেষ করে বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে, পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দের সাথে নেপালের অংশীদারিত্বকেও প্রভাবিত করে। বাম জোটের পুনরুত্থান নেপালের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে মতাদর্শ, ভূ-রাজনীতি এবং আঞ্চলিক শক্তির গতিশীলতার জটিল আন্তঃপ্রক্রিয়ার ওপর জোর দেয়।