সোহানুর রহমান, দীঘিনালা (খাগড়াছড়ি) প্রতিনিধি: টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চরম বিপর্যয়ের মুখে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলা। রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সম্প্রতিকালে অতিবৃষ্টি ও ভারতের ত্রিপুরা প্রদেশ থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে প্লাবিত হয়েছে এসকল গ্রাম।
এদিকে উপজেলার পানিতে বন্দি হয়েছে মেরুং ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্রও। প্লাবিত হয়েছে দীঘিনালার তিন ইউনিয়নের ৫০ গ্রাম। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মাইনী নদীর পানি বাড়তে থাকায় এর মধ্যেই ডুবে গেছে জেলার বিভিন্ন সড়ক, কৃষি জমি ও পুকুর। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
উপজেলার পুরাতন বাজারের বাসিন্দা আবু জাফর বলেন, ‘এতো পানি গত ১০ বছরেও দেখি নাই। এ বছরেই কয়েক মাসের ব্যবধানে ০৪ বার ঘরে পানি উঠলো। চলাচলের সড়ক গুলো ডুবে গেছে। পরিবারের লোকজন নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছি।’
আরেক বাসিন্দা আব্দুল কাদের বলেন, টানা এক সপ্তাহের বৃষ্টি আর মাইনী নদীতে পানি বেড়ে গিয়ে সোবাহানপুর, চৌধুরীপাড়া, চিটাংপড়া, মেরুং বাজার, পুরাতন বাজার, হাসিনসনপুর, মুসলিমপাড়া, বানছড়া, শান্তিপুর সহ আরো কিছু গ্রাম পুরাপুরি পানির নিচে।
পাহাড়ি ঢলে হেডকোয়ার্টার এলাকায় দীঘিনালা-লংগদু সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হয়েছে দীঘিনালার মেরুং, বোয়ালখালি ও কবাখালি ইউনিয়নের ৫০ গ্রাম। ডুবে গেছে মেরুং বাজার।
এদিকে মঙ্গলবার বিকাল থেকে সাজেক সড়কের কবাখালি, বাঘাইহাট বাজার ও মাচালং বাজারসহ একাধিক অংশ পাঁচ থেকে ছয় ফুট পানির নীচে তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ ছিল যান চলাচল। শুক্রবার বিকাল থেকে এই সড়কে যানচলাচল শুরু হয়েছে।
মেরুং ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সমীরন চাকমা বলেন, আমার ওয়ার্ডের প্রায় ৭ গ্রাম এখনো বন্যার পানিতে ডুবে আছে। সোমবার রাত থেকে তারা পানিবন্দি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুক্রবার দুর্গম এলাকার পরিবার গুলোকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
মেরুং ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ঘনশ্যাম ত্রিপুরা বলেন, পানি না কমায় মেরুং ইউনিয়নের বন্যা দুর্গত এলাকার মানুষ বাড়ি ফিরতে পারিনি। বন্যায় অন্তত ৪০ গ্রাম এখনো পানিবন্দি। মেরুং বাজার এখনো পানিতে প্লাবিত। সবকটি আশ্রয় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
খাগড়াছড়ির প্রথম শ্রেণি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় ০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রের্কড করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে ২৪ ঘন্টায় পরিস্থিতি উন্নতি হতে পারে।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ৫০টি গ্রামের পানিবন্দি মানুষের সহায়তায় পৃথক পৃথক ভাবে পাশে দাড়িয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় শুকনা খাবার বিতরণ করে সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসন। এসময় সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বন্যার্ত তিন শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্র নিয়ে আসেন। এছাড়াও উপজেলার কবাখালী ইউনিয়নে অস্থায়ী চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছে সেনাবাহিনী।
এদিকে পৃথক পৃথক ভাবে ইঞ্চিন চালিত নৌকা নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেওয়া মানুষদের ত্রাণ সহায়তা প্রদান করতে দেখা যায় সেনাবাহিনী ও উপজেলা প্রশাসনকে। এতে সরেজমিনে দীঘিনালা জোনের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল ওমর ফারুক পিএসসি ও দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মামুনুর রশীদ উপস্থিত ছিলেন।
দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোঃ মামুনুর রশীদ বলেন, উপজেলায় প্রায় ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য গরম খাবার ও শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপজেলায় ২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ইতিমধ্য জেলা প্রশাসন থেকে বন্যা মোকাবেলায় ৩০ মেট্রিকটন খাদ্যশস্য ও নগদ ১ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। বন্যা মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসনের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, এনজিও কর্মী, সেচ্ছাসেবী ও সুশীল সামাজের নাগরিকদের সমন্বয়ে প্লাবিত এলাকাগুলোতে সরেজমিনে খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে।’
মেরুং ইউনিয়নের প্লাবিত অনেক গ্রামে মোবাইল সংযোগ নেই। শুক্রবার সেসব দুর্গম এলাকায় ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে উপজেলা প্রশাসন।
ইউএনও মো.মামুনুর রশিদ আরো বলেন, আজকে আমরা একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণ দিয়েছি। যে সমস্ত এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই তাদের পরিস্থিতি আমরা সরেজমিনে দেখেছি। দুর্গম এলাকায় দেড় শতাধিক পরিবারকে শুকনো খাবার, চাল, ডালসহ খাদ্য উপকরণ দেওয়া হয়েছে।
পানিতে আটকা পড়া মানুষজনদের উদ্বার করে নিরাপদে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। আশ্রিতদের জন্য শুকনা খাবারের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে গরম খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ।
অন্যদিকে, বন্যা দুর্গতদের মধ্যে তিনদিন ধরে রান্না করা খাবার বিতরণ করছে উপজেলা বিএনপি ও অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। শুক্রবার দুপুরে উপজেলার মেরং এলাকায় খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়।