কুমিল্লার যুবলীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন। একসময় বাজারে ২০০ টাকা বেতনে খাজনা তুলতেন। নিমসার বাজার এক যুগ দখলে রেখেই প্রায় শতকোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, বাজারের ইজারায় শেয়ার দেওয়ার কথা বলে স্থানীয় ৭-৮ জনের কাছ থেকেও নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। পরে তা আর ফেরত দেননি। এছাড়া অনেকের জমি দখল করে গড়েছেন পর্যটনকেন্দ্র ও মাছের খামার। নিজ গ্রামে দুই স্ত্রীর জন্য বানিয়েছেন দুটি বিলাসবহুল বাড়ি।
মামুন ময়নামতীর আকাবপুর গ্রামের মৃত আবদুল মান্নানের ছেলে। তিনি ময়নামতী ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
জানা যায়, ২০১২ সালে কুমিল্লার নিমসার কাঁচাবাজার ইজারার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে মামুন দলবল নিয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকেন। বাজারের ইজারামূল্য ১ কোটি টাকা হলেও মামুন হাঁকান ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা। ফলে তিনিই ইজারা পেয়ে যান। কিন্তু পরে মাত্র কয়েক লাখ টাকা দিয়ে বাকি টাকা ঝুলিয়ে রাখেন। প্রশাসনের কাছে বাকি টাকা পরিশোধের জন্য বারবার সময় চান। এভাবে কোটি টাকার বাজার দখলে নেন তিনি। প্রতিদিন মামুন নিমসার কাঁচাবাজার থেকে তার লোকজনের মাধ্যমে খাজনা বাবদ আদায় করতেন ২ লাখ টাকা, যা মাসে দাঁড়ায় ৬০ লাখ টাকা। বছরে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা। ২০১২ সাল থেকে বাজারটি দখলে নিয়ে খাজনা তুলছেন মামুন। ১২ বছরে বাজারটি থেকে হাতিয়ে নেন প্রায় শতকোটি টাকা।
এ বিষয়ে বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাহিদা আক্তার জানান, আবদুল্লাহ আল মামুন এখনো ইজারার টাকা পরিশোধ করেননি। ইজারার পুরো টাকা জমা না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে ২০১৫ সালে মামলা হয়েছে। সেই মামলা এখনো চলমান।
জানা যায়, মামুন নিমসার বাজার ইজারা নিয়ে শেয়ার দেওয়ার কথা বলে স্থানীয় অনেকের কাছ থেকে টাকাও ধার নিয়েছেন। কিন্তু তাদের শেয়ার বা লভ্যাংশ দেওয়া তো দূরের কথা, তাদের আসল টাকাই আর ফেরত দেননি। ময়নামতী ইউনিয়নের জিয়াপুর গ্রামের অ্যাডভোকেট মাহাবুবের কাছ থেকে নিয়েছেন ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। আকাবপুর গ্রামের আবদুল হালিমের কাছ থেকে নিয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ টাকা। একই এলাকার পাগড়ি সবুজের কাছ থেকে ৪০ লাখ, কামাল উদ্দিনের কাছ থেকে ৫০ লাখ এবং হোটেল মালিক তাজুল ইসলাম বাশুরীর কাছ থেকে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নিয়েছেন। শংকরপুরের মতিন মেম্বারের কাছ থেকে ২০ লাখ, বারাইর গ্রামের মনির হোসেনের কাছ থেকে ৫০ লাখ এবং তাজুল ইসলামের কাছ থেকে নিয়েছেন ১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট মাহাবুব বলেন, মামুন একজন প্রতারক, তিনি আমার কাছ থেকে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা নিয়ে নিমসার বাজারে আমাকে একটি শেয়ার দেবেন বলেছিলেন। কিন্তু সেই টাকা আজও ফেরত দেননি।
এছাড়া মামুন আকাবপুর গ্রামের জাকির হোসেন মাস্টারের ৪ একর জমি দখল করে তৈরি করেছেন পর্যটনকেন্দ্র। জমি দখলের জন্য মামুন তার ভাই ইয়াবা ব্যবসায়ী মিজান, মাদক ব্যবসায়ী কালা মানিক, মাসুদ, রিয়াদ ও আবুল কাশেমকে ব্যবহার করতেন তিনি। জমি দখল করায় জাকির হোসেন তার কাছে ২০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে কুমিল্লার আদালতে মামলা করেছেন। এছাড়া বুড়িচং মোকাম ইউনিয়নের বারাইর গ্রামের নাবালক মিয়া ও তার ভাই সাবালক মিয়ার ৩ একর জমি দখল করে মাছের খামার গড়ে তুলেন মামুন।
স্থানীয়রা জানান, ময়নামতীর নিজ গ্রাম আকাবপুরে ৪টি বিলাসবহুল বাড়ি বানিয়েছেন মামুন। আকাবপুর গ্রামে দুই স্ত্রী রোকেয়া বেগম ও আঁখি আক্তারের নামে দুটি এবং ছেলে ও মেয়ের নামে দুটি বাড়ি করেছেন। মামুনের বিরুদ্ধে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মাদকের মামলাও রয়েছে। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়েছে।
জাকির হোসেন মাস্টার বলেন, মামুন স্থানীয় অনেকের জমিই দখল করেছেন। কেউ কেউ ইতোমধ্যে কিছু জমি উদ্ধার করেছেন, তবে এখনো ১২০০ শতকের বেশি জমি তার দখলে রয়েছে।
আকাবপুর গ্রামের গনি মিয়া বলেন, মামুনের বাড়ির সঙ্গে আমার ১০ শতক জায়গা ছিল। আমাকে নামমাত্র কিছু টাকা দিয়ে সেই জায়গা দখল করে নিয়েছেন।
স্থানীয় শিক্ষক জাকির আলম বলেন, মামুন আমার ৩৬০ শতক জমি তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দখল করে নেন। আমি তার বিরুদ্ধে বুড়িচং থানায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমালে লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ তার পক্ষ নিয়ে নামমাত্র টাকায় জমিটি তার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তাতে আমি রাজি হইনি।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার আসফিকুজ্জামান আক্তার বলেন, আমরা মামুনকে গ্রেফতার করতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বুড়িচং থানার ওসি আজিজুল হক বলেন, কিছুদিন আগে মামুনের বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।