এস এম জহিরুল আলম চৌধুরী (টিপু), বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি: চায়না কমলা চাষ করে কৃষিতে নতুন চমক সৃষ্টি করেছেন প্রবাস ফেরত দুই যুবক। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের দুলালপুর গ্রামের বাসিন্দা আলমগীর ভূঞা ও একই ইউনিয়নের ছতুরপুর গ্রামের খোকন মিয়া। তারা দুজনেই প্রবাসে ছিলেন। কর্মের তাগিদে কয়েক বছর পূর্বে প্রবাসে পাড়ি দেন তারা। তবে প্রবাসে গিয়ে তেমন সুবিধা না করতে পারায় দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে হতাশায় ভুগছিলেন। একপর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ইউটিউবের ভিডিও দেখে কমলা চাষের প্রতি আগ্রহ জাগে তাদের।
প্রথমে এ উপজেলায় চায়না কমলা চাষের উদ্যোগী হন প্রবাস ফেরত যুবক আলমগীর ভুঞা। তিনি চুয়াডাঙ্গা থেকে কমলার চারা এনে প্রথমে ২ বিঘা জমিতে রোপণ করেন। তখন অনেকেই তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিল। পরে ১ বছর পর তার রোপণ করা চারা গাছে কমলা আসতে শুরু করে। পরে তার বাগান দেখে পার্শ্ববর্তী ছতুরপুর গ্রামের খোকন মিয়াও চায়না ও দার্জিলিং কমলা চাষে উদ্ধুদ্ধ হয়ে বাগান করেন। বর্তমানে তারা দুজনই চায়না ও দার্জিলিং কমলা চাষে সফল হয়েছেন এবং কমলা চাষে তাদের আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর কমলার ফলন ভালো হয়েছে। পুরো বাগানে সবুজ পাতার আড়ালে ঝুলছে হলুদ রঙের কমলা, যা মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে।
এদিকে, ছতুরপুর গ্রামের কমলা চাষি খোকন মিয়া জানান, তিনি দুই বিঘা জমিতে ৬০টি দার্জিলিং ও ১০০টি চায়না থ্রি কমলার চারা রোপণ করে বাগান গড়ে তুলেছেন। ইউটিউব দেখে বাগানের পরিচর্যা করে তিনি ভালো ফলন পেয়েছেন। বাগানের গাছগুলোতে সবুজ পাতার আড়ালে ঝুলছে পাকা রসালো কমলা। খোকন মিয়া আরও বলেন, ‘গত বছর ১ হাজার কেজির বেশি কমলা বিক্রি করেছি। এবছর দ্বিগুণ ফলন এসেছে। প্রতি কেজি চায়না থ্রি কমলা ১৮০ টাকা কেজি ও দার্জিলিং কমলা ২৫০ টাকা কেজি মূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। বাগান থেকে ক্রেতারা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে হয়নি। দর্শনার্থীরা এসে দেখে বাগান থেকেই কমলা ক্রয় করছেন। বাগান করার সময় গ্রামের অনেকেই বলেছিলেন, এই এলাকায় কমলার চাষ হবে না। আমি মানুষের কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো করে চেষ্টা করেছি। আমার বাগান থেকে এবছর অন্তত ৫ লাখ টাকার কমলা বিক্রির আশা করছি।’
বিজয়নগরে প্রথম কমলা চাষি আলমগীর ভুঞা জানান, দীর্ঘদিন প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে তিনি মাত্র দুই বিঘা জমি ১৬ বছরের জন্য বর্গা নিয়ে ইউটিউব দেখে চায়না কমলা-থ্রি জাতের চাষ শুরু করেন। চার বছর আগে ১৭০টি চায়না কমলার চারা রোপণের পর তিনি সফলতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। চারা লাগানোর পর অনেকেই তাকে নিরুৎসাহিত করলেও তিনি হাল ছাড়েননি। মাত্র ৪ লাখ টাকা নিয়ে সাহসিকতার সঙ্গে শুরু করেন চাষাবাদ। এখন সবুজ পাতার ফাঁকে-ফাঁকে ঝুলছে নজরকাড়া ছোট-ছোট হলুদ রঙের চায়না কমলা। গত বছরের তুলনায় এবছর ফলন ভালো হয়েছে। গত বছর তার বাগান থেকে ১৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা বিক্রি হয়েছিল। এবছর আরো বেশি বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
এদিকে, বিজয়নগরে কমলা চাষের খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার হলে বিভিন্ন এলাকা থেকে দর্শনার্থীরা বাগান দেখতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন। বাগানে এসে ফটোসেশন, সেলফি তুলতে দেখা গেছে অনেককেই। একপর্যায়ে কমলা বাগান এখন পর্যটনের ভেন্যুতে রূপ নিয়েছে। রঙিন কমলার স্বাদ নিতে ভ্রমণপিপাসুরা আসছেন প্রতিনিয়ত। বাগান পরিদর্শন শেষে টাটকা কমলা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছে তারা। এখানকার কমলা স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলাতেও পাইকাররা এসে নিয়ে যাচ্ছেন। কমলা বাগানের এমন দৃশ্য দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় জমান দর্শনার্থীরা। চারদিকে এমন দৃশ্য দেখে এবং বাগানে কমলা খেয়ে তারা তুষ্টির কথা জানান।
উপজেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, বিজয়নগর একটি কৃষিতে সম্ভাবনাময় উপজেলা। এ উপজেলায় নানা সবজি ও ফলমূল আবাদ হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের লিচুর খ্যাতি পুরো দেশজুড়ে। কাঁঠাল, পেয়ারা, ড্রাগন, আম, আনারস, বড়ই, গ্রীন মাল্টা চাষ হচ্ছে। এরই মধ্যে ৩/৪ বছর আগে প্রথম চায়না কমলা চাষ শুরু হয় পরীক্ষামূলকভাবে। তবে এখন দেখা যাচ্ছে, এ অঞ্চলের মাটিতে চায়না কমলাও বানিজ্যিকভাবে চাষ করা যাবে। তাই নতুন করে কমলা চাষে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন। এখন পর্যন্ত ২ হেক্টর জমিতে চায়না কমলা আবাদ করেছেন দুইজন কৃষক। সামনে কমলার বাগান আরো বাড়বে বলে আশা। কৃষি বিভাগ এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
আখাউড়া থেকে কমলা বাগান দেখতে আসা খাদিজা আক্তার বলেন, ‘কমলা বাগানে এত সুন্দরভাবে কমলা ঝুলে আছে, যা দেখে মন জুড়িয়ে গেল। আমাদের পার্শ্ববর্তী এত সুন্দর কমলা বাগান তা জানতাম না। ফেইসবুকের ছবি দেখে বাগানে এসেছি। কমলা বাগান দেখে আমি মুগ্ধ। আর কমলা খেয়ে দেখলাম অনেক সুস্বাদু।’
বাগানে পরিচর্যা ও প্রতিনিয়ত কাজ করেন ছাত্তার মিয়া। তিনি বলেন, ‘বাগান দেখাশুনা সহ কমবেশি সব কাজ করি। এই বাগানে আমরা ৩/৪ জন কাজ করি। এখানে কাজ করে আমাদের পরিবারের অর্থের যোগান দিচ্ছি।’
বিজয়নগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘জমি উপযোগী হওয়ায় উপজেলায় কমলা ও মাল্টা বাগানের আবাদ ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। বাগান করে সফল হচ্ছেন কৃষকেরা। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাদের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’