সময়টা ২০০৫ সালের নভেম্বর মাস। রোববারের একটা শান্ত সন্ধ্যায় বিহারের এক সাংবাদিকের বাড়িতে হঠাৎই ফোন আসে। ফোনের অন্যপ্রান্তে ছিল আতঙ্কিত একটা কণ্ঠ।
‘মাওবাদীরা জেলে হামলা চালিয়েছে। মানুষ মরছে! আমি বাথরুমে লুকিয়ে রয়েছি’- কাঁপা কাঁপা গলায় হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলেছিলেন ফোনের অন্যপ্রান্তে থাকা এক বন্দি। তার কথার মাঝে ব্যাকগ্রাউন্ডে গুলির শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
দারিদ্র্যপীড়িত জেলা জেহানাবাদের একটা জেল থেকে ফোন করছিলেন তিনি। সেই সময় বাম চরমপন্থীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল জেহানাবাদ।
লাল ইঁট দিয়ে তৈরি ঔপনিবেশিক আমলের এই কারাগার জায়গায় জায়গায় ভেঙে পড়েছে। উপচে পড়া বন্দিদের ভিড়ে ঠাঁসা ছিল এই কারাগার যা এক একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।
জেলের ১৩টা ব্যারাক এবং সেলকে সরকারি প্রতিবেদনে বর্ণনা করা হয়েছে, অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে ও নোংরা বলে। আনুমানিক ২৩০ জনের জন্য তৈরি করা হলেও সেখানে ৮০০জন বন্দিকে রাখা হতো।
ষাটের দশকের শেষের দিকে পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নেপাল সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম নকশালবাড়ি থেকে শুরু হওয়া মাওবাদী বিদ্রোহ বিহারসহ ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রায় ৬০ বছর ধরে গেরিলারা (যাদের নকশালও বলা হয়) একটা কমিউনিস্ট সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এই আন্দোলনে কমপক্ষে ৪০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
ভারতে জায়গাভেদে এই বাম চরমপন্থীদের কোথাও নকশালপন্থী এবং কোথাও মাওবাদী বলে চিহ্নিত করা হয়।
বলা যেতে পারে একপ্রকার বারুদের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়েছিল জেহানাবাদের কারাগার। সেখানে মাওবাদীদের পাশাপাশি তাদের শ্রেণি শত্রু হিন্দু উচ্চবর্ণের নিজস্ব ঘাতক বাহিনীর সদস্যরাও বন্দি ছিলেন।
পারস্পরিক নৃশংস সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে জড়িত এই অভিযুক্তদের প্রায় সকলেই বিচারের অপেক্ষায় ছিলেন। ভারতের অনেক জেলের মতোই জেহানাবাদের কিছু বন্দির কাছেও মোবাইল ফোন ছিল যার জন্য রক্ষীদের ঘুস দিতে হতো তাদের।
ওই সাংবাদিককে ফোনে ফিসফিস করে সেই বন্দি বলছিলেন, বিদ্রোহীতে ভরে গিয়েছে এই জায়গাটা। অনেকেই এমনিই বেরিয়ে যাচ্ছে।
জেহানাবাদ কারাগার থেকে ২০০৫ সালের ১৩ নভেম্বর রাতে একাধিক বিদ্রোহীসহ ৩৮৯ জন বন্দি পালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এটাই ছিল ভারতের এবং সম্ভবত এশিয়ার সবচেয়ে বড় জেল পালানোর ঘটনা। সেই সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত দু’জনের মৃত্যু হয়। বিশৃঙ্খলার মধ্যে পুলিশের রাইফেল লুঠ করা হয়েছিল।
২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক প্রতিবেদনে এই ঘটনারও উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ঘটনার সময় বিদ্রোহীরা ওই কারাগারের ৩০জনকে অপহরণ করেছিল যারা মাওবাদী বিরোধী গোষ্ঠীর সদস্য ছিলেন।
ভারতীয় পুলিশ জানিয়েছে জেল পালানোর ঘটনার মাস্টারমাইন্ড বা মূল হোতা হলেন বিদ্রোহী নেতা অজয় কানু যিনি নিজেও ওই কারাগারেরই একজন বন্দি ছিলেন।
জরাজীর্ণ জেহানাবাদ কারাগারে নিরাপত্তা এতটাই ঢিলেঢালা ছিল যে তিনি ফোন এবং মেসেজের মাধ্যমে তার গোষ্ঠীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। পুলিশের দাবি ওই সদস্যদের জেলের ভিতর ঢুকতেও সাহায্য করেছিলেন অজয় কানু। অবশ্য কানু পাল্টা দাবি জানিয়েছেন পুলিশের অভিযোগ সত্যি নয়।
ঘটনার রাতে, পুলিশের পোশাক পরে জেলে ঢুকে পড়েছিলেন বিদ্রোহীরা। কারাগারের পেছনে শুকিয়ে আসা একটা নদী অতিক্রম করে এসেছিলেন তারা। লম্বা বাঁশের মই ব্যবহার করে জেলের উঁচু দেয়াল বেয়ে ভেতরে ঢুকেই রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন।
ওই রাতে রান্নায় দেরি হওয়ার কারণে জেলের সেলগুলো খোলা ছিল। বিদ্রোহীরা ভেতরে ঢুকে জেলের প্রধান ফটক খুলে দেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে কর্তব্যরত প্রহরীরা সেই সময় অসহায় অবস্থায় তাকিয়ে ছিলেন।
যে বন্দিরা পালিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মাত্র ৩০ জন সংশ্লিষ্ট মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। কারাগারের বাকি বন্দিরা ছিলেন বিচারের অপেক্ষায়। সেই রাতে জেহানাবাদের জেলের ফটক থেকে সোজা হেঁটে বেরিয়ে যান তারা, তারপর অন্ধকারে মিলিয়ে যান।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এক ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে এই পুরো অভিযান শেষ হয়ে গিয়েছিল। জেহানাবাদের জেল থেকে পালানোর ঘটনা বিহারের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা এবং ভারতের অন্যতম দরিদ্র অঞ্চলে মাওবাদীদের বিদ্রোহের তীব্র হয়ে ওঠার বিষয়টাকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে।
বিদ্রোহীরা তাদের পরিকল্পনার ছক নিখুঁতভাবে কষেছিল। জেল ভাঙার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্য তারা এমন সময় বেছে নিয়েছিল যখন সেই রাজ্যে নির্বাচনের কারণে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অপ্রতুল।
ঘটনার রাতের কথা স্পষ্টভাবে মনে আছে স্থানীয় সাংবাদিক রাজকুমার সিংয়ের।
জেহানাবাদ কারাগার থেকে বন্দির ফোন পেয়েই বেরিয়ে পড়েন তিনি। নির্জন শহরের মধ্য দিয়ে মোটরবাইকে চেপে দ্রুত অফিসে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন।
রাজকুমারের মনে আছে, দূর থেকে গুলির শব্দে বাতাসে ভেসে আসছিল। সেই রাতে বিদ্রোহীরা পার্শ্ববর্তী একটা থানাতেও হামলা চালানোর চেষ্টা করে।
প্রধান সড়কের দিকে মোড় নেওয়ার সময় রাস্তার আবছা আলোয় হাড়হিম করা একটা দৃশ্য চোখে পড়ে তার।
পুলিশের পোশাক পরা সশস্ত্র পুরুষ ও নারীরা পথ আটকাচ্ছেন। মেগাফোন ব্যবহার করে চিৎকার করে ঘোষণা করছেন, আমরা মাওবাদী। কিন্তু আমরা জনগণের বিরুদ্ধে নই। আমরা শুধু সরকারের বিরুদ্ধে। এই জেল ভাঙা আমাদের প্রতিবাদেরই একটা অংশ।
রাস্তার পাশে বোমা পুঁতে রেখেছিল বিদ্রোহীরা। তারই মধ্যে কয়েকটা বোমার ইতিমধ্যে বিস্ফোরণ হওয়ায় আশপাশের দোকানপাট বিপর্যস্ত হয়ে যায়। শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সাংবাদিক রাজকুমার সিং কোনো মতে দ্রুত গাড়ি চালিয়ে তার অফিসে পৌঁছান। ততক্ষণে জেহানাবাদ কারাগারের ওই বন্দির কাছ থেকে দ্বিতীয় ফোন আসে। মোবাইল ফোনের অপর প্রান্তে থাকা বন্দি প্রশ্ন করেন, সবাই দৌড়াচ্ছে। আমি কী করব?
এর উত্তরে রাজকুমার তাকে বলেন, সবাই যদি পালিয়ে যায়, তা হলে আপনাকেও পালাতে হবে।
নির্জন রাস্তা দিয়ে কারাগারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন সাংবাদিক রাজকুমার সিং। তারপর ফটক দিয়ে সোজা জেলের ভিতরে ঢুকে পড়েন। সেখানে পৌঁছে দেখেন কারাগারের দরজা খোলা, রান্নাঘর জুড়ে খাবার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, সেলের দরজাও খোলা। সেখানে কোনো জেলরক্ষী বা পুলিশকর্মীকে দেখা যাচ্ছিল না।
একটা কক্ষে দু’জন আহত পুলিশকর্মী মেঝেতে পড়ে ছিলেন। রণবীর সেনা নামে পরিচিত জমিদারদের উচ্চবর্ণের নিজস্ব ঘাতক বাহিনীর নেতা বড়ে শর্মার রক্তাক্ত দেহ লক্ষ্য করেন তিনি। বড়ে শর্মা নিজেও ওই জেলের একজন বন্দি ছিলেন। পরে পুলিশের তরফে জানানো হয়, পালানোর সময় বিদ্রোহীরা তাকে গুলি করেছিল।
বিদ্রোহীদের ফেলে যাওয়া হাতে লেখা কিছু প্রচারপত্র মেঝেতে ছড়িয়ে ছিল, আর কিছু দেওয়ালের গায়ে সাঁটা।
তেমনই একটা প্রচারপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, এই প্রতীকী পদক্ষেপের মাধ্যমে আমরা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করে দিতে চাই যে তারা যদি বিপ্লবীদের ও সংগ্রামী জনগণকে গ্রেফতার করে কারাগারে আটকে রাখে তবে আমরাও জানি কীভাবে মার্কসবাদী বিপ্লব ঘটিয়ে তাদের কারাগার থেকে মুক্ত করতে হয়।
কয়েক মাস আগে বিহারের রাজধানী পাটনায় অজয় কানুর সঙ্গে সাংবাদিক রাজকুরেরর দেখা হয়। এই বিদ্রোহী নেতাকে জেল পালানোর ঘটনার মূল চক্রান্তকারী বলে পুলিশ মনে করে।
জেহানাবাদে জেল ভাঙার ঘটনার পর গণমাধ্যমে ‘বিহারের মোস্ট ওয়ান্টেড’ এই ব্যক্তিকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছিল যিনি পুলিশের কাছ থেকে ‘ভয় এবং শ্রদ্ধা’ দুইই দাবি করেন।
পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন কীভাবে এই বিদ্রোহী ‘কমান্ডারের’ হাতে তার সঙ্গীরা একে-৪৭ তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এই পুরো অভিযানের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে নেন।
নাটকীয় ভাবে রিপোর্টে বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে অজয় কানু ‘দক্ষতার সঙ্গে’ ওই অস্ত্র ব্যবহার করছিলেন।
পুলিশের দাবি, বড়ে শর্মাকে নিশানা করে গুলি চালানোর আগে দ্রুত বন্দুকের ম্যাগাজিনও বদলে ফেলেন তিনি।
ঘটনার পনেরো মাস পর, ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, বিহারের ধানবাদ থেকে কলকাতা শহরে যাওয়ার পথে একটা রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রায় দুই দশক পরে, তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মূল ৪৫টা ফৌজদারি মামলার মধ্যে ছয়টা বাদে সবকটা মামলা থেকেই খালাস পেয়েছেন অজয় কানু।
বড়ে শর্মাকে হত্যাসহ তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার বেশিরভাগই জেল ভাঙার ঘটনা সংক্রান্ত। এর মধ্যে একটা মামলায় সাত বছর জেলও খেটেছেন তিনি।
তার ‘ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্বের’ জন্য একসময় পরিচিত হলেও অজয় কানু বেশ কথা বলেন, যা অপ্রত্যাশিত। তিনি তীক্ষ্ণ, বাছাই করা শব্দে উত্তর দেন। জেল ভেঙে এই বিপুল সংখ্যক কয়েদি পালানোর ঘটনায় নিজের ভূমিকাকে খাটো করে দেখান। এটা কিন্তু সেই ঘটনা যা এক সময় খবরের শিরনামে ছিল।
সেই সময়ের বিদ্রোহী নেতা অতি সূক্ষ্মভাবে তার নজর অন্য এক যুদ্ধের দিকে ঘুরিয়েছেন। রাজনীতিতে ক্যারিয়ার গড়তে চান তিনি দরিদ্র পিছিয়ে পড়া বর্ণের মানুষের জন্য লড়াই করতে চেয়ে।
তথা কথিত নিম্নবর্ণের কৃষক পরিবারের ছেলে অজয় কানু। ছোটবেলায় পেশায় কৃষক বাবার কাছ থেকে রাশিয়া, চীন ও ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট বিদ্রোহের গল্প শুনে দিন-রাত কাটাত তার। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বাবার সঙ্গীসাথীরা তাকে বিপ্লবী রাজনীতি করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
অজয় কানু তার স্মৃতির পাতা ঘেঁটে জানান স্থানীয় জমিদারের ছেলের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ফুটবল ম্যাচে তার বিরুদ্ধে গোল করার পর তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকেরা তাদের বাড়িতে সশস্ত্র হামলা চালায়।
তিনি সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলছিলেন, আমি দরজা বন্ধ করে ঘরের ভিতরে লুকিয়ে ছিলাম। আমাকে আর বোনকে খুঁজতে এসেছিল ওরা। ঘরবাড়ি তছনছ করে সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল। এভাবেই উচ্চবর্ণ লোকেরা আমাদের ভয় দেখিয়ে আটকে রাখত।
চমকপ্রদভাবে কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াকালীন হিন্দু-জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ছাত্র শাখার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। বিজেপি কিন্তু মাওবাদের বিরুদ্ধে। স্নাতক হওয়ার পর তিনি একটা স্কুল সহ-প্রতিষ্ঠা করেন। যে ভবনে ওই স্কুল ছিল তার মালিক তাকে জোর করে বের করে দিয়েছিলেন।
গ্রামে ফেরার পর স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে তার সম্পর্কে ঘিরে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। সেই সময় স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তিকে খুন করা হয়। এই ঘটনায় পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগে তার নামও ছিল। তখন মাত্র ২৩ বছর বয়স অজয় কানুর। তারপর থেকেই আত্মগোপন করেন তিনি।
তার কথায়, ওই ঘটনার পর থেকে আমি আমার জীবনের বেশিরভাগ সময়ই পালিয়ে বেরিয়েছি। শ্রমিক ও কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য আমি বাড়ি ছেড়েছিলাম। মাওবাদী বিদ্রোহী হিসাবে যোগ দিই এবং আত্মগোপন করি।
অতিবাম সংগঠন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) যোগ দেন তিনি।
কানু বলেন, দরিদ্রদের মুক্তি চেয়েছিলাম আমি। উচ্চবর্ণের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই আমার লক্ষ্য ছিল। যারা অন্যায় ও নিপীড়ন সহ্য করে এসেছে তাদের জন্য আমি লড়াই করেছি।
২০০২ সালের আগস্টে, বিদ্রোহী নেতা হিসাবে খ্যাতি কুড়ান তিনি। তার মাথার দাম নির্ধারণ করা হয় ৩০ লক্ষ টাকা। আর তার দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার সময় কেউ যদি এই অজয় কানুর খোঁজ দিতে পারেন তাহলে সে বাবদ আলাদা পুরস্কার।
এই পরিস্থিতিতেই পাটনায় তার গন্তব্যে প্রায় পৌঁছানোর আগেই একটা গাড়ি তাকে ওভারটেক করে।
কানু বলছিলেন, মুহূর্তের মধ্যে সাদা পোশাক পরা কিছু লোক লাফিয়ে বেরিয়ে আসে। বন্দুক উঁচিয়ে আমাকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। আমি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করিনি- আমি হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম।
তিনি বলছেন, পরের তিন বছর পুলিশ তাকে এক কারাগার থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করে। তাদের আশঙ্কা ছিল পালিয়ে যেতে পারেন এই বিদ্রোহী নেতা। একজন সিনিয়র অফিসার আমাকে বলেছিলেন, ওর অসাধারণ খ্যাতি ছিল। ও ছিল সবচেয়ে তীক্ষ্ণ।
অজয় কানু জানিয়েছেন প্রতিটা জেলেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বন্দিদের ইউনিয়ন গঠন করেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য ছিল রেশন চুরি ও ঘুস বন্ধ করা এবং জেলে নিম্ন মানের স্বাস্থ্য পরিষেবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
একটা জেলে তিন দিনের অনশন ধর্মঘটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। তার কথায়, ওখানে সংঘর্ষ হয়েছিল। কিন্তু আমি আরও ভাল অবস্থার দাবি করতে থাকি।
এই প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভারতের কারাগারে উপচে পড়া ভিড়ের একটি স্পষ্ট চিত্র এঁকেছেন তিনি। জেহানাবাদ জেলের বর্ণনা দিয়ে জানিয়েছেন কীভাবে ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি বন্দিদের রাখা হতো সেখানে।
জেহানাবাদের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেছেন, ওখানে ঘুমানোর জায়গা ছিল না। আমার প্রথম ব্যারাকে, ১৮০জনকে গাদাগাদি করে রাখা হয়েছিল যদিও তা ৪০ জনের জন্য নির্ধারিত। আমরা বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের মধ্যেই একটা সিস্টেম তৈরি করে নিয়েছিলাম।
তিনি বলছেন, আমাদের মধ্যে পঞ্চাশজন চার ঘণ্টা ঘুমাত এবং অন্যরা বসে থাকতম। অন্ধকারে অপেক্ষা করতাম, গল্প করতাম। চার ঘণ্টা শেষ হলে অন্যদের পালা আসত। এই ভাবেই আমরা জেলের ভিতরের জীবন সহ্য করেছি।
সেই রাতের ঘটনা মনে করে বলেন, আমরা রাতের খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। বোমা, বুলেট – সে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ছিল। মাওবাদীরা ঢুকে পড়ে চিৎকার করে আমাদের পালিয়ে যেতে বলে। সবাই অন্ধকারে পালিয়ে যায়। আমার কি তাহলে সেখানে থেকে গিয়ে মরে যাওয়া উচিৎ ছিল?
তবে সে রাতের ঘটনা সম্পর্কে অজয় কানুর ‘দাবি’ নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
এক পুলিশ কর্মকর্তার কথায়, কথাটা যতটা সহজ শোনাচ্ছে, ততটা সহজ ছিল না। কেন রাতের খাবার সেদিন অত দেরিতে প্রস্তুত করা হচ্ছিল? সাধারণত সন্ধ্যায় রান্না করে খাবার পরিবেশন করে দেওয়া হতো যাতে সেলগুলো তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেওয়া যায়। এটাই ভিতরের আঁতাতের বিষয়ে সন্দেহ তৈরি করে।
মজার ব্যাপার হলো, যেসব বন্দি পালিয়ে গিয়েছিলেন তাদের অনেকেই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে কারাগারে ফিরে আসেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় এসেছিলেন অন্যদের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তবে বিদ্রোহীদের কেউই ফিরে আসেনি।
অজয় কানুকে জিজ্ঞাসা করা হয় জেল থেকে পালানোর ঘটনার মূলচক্রী কি তিনি? এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, মাওবাদীরা আমাদের মুক্ত করেছে- তাদের কাজ মুক্ত করা।
একই প্রশ্ন তাকে আবারও করা হলে, তিনি চুপ করে যান। শেষ পর্যন্ত জেলে থাকাকালীন এক ঘটনার উল্লেখ করেন অজয় কানু। তার এই গল্প কিন্তু সন্দেহকে আরও উস্কে দেয়।
তিনি বলেন, একবার এক পুলিশ অফিসার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি আবারও পালানোর পরিকল্পনা করছেন কিনা। উত্তরে অজয় কানু নাকি বিদ্রূপের সুরে বলেছিলেন, স্যার, চোর কি আপনাকে কখনো বলে যে সে কি চুরি করবে?
তার বলা এই কথাগুলো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছিল। কথাগুলো এমন এক ব্যক্তির যিনি বরাবর জোর দিয়ে বলে এসেছেন জেহানাবাদ জেল পালানোর ঘটনায় তার কোনও ভূমিকা নেই।