চিলমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি: কুড়িগ্রাম জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত কড়ালগ্রাসী ব্রহ্মপুত্র নদ চিলমারী উপজেলার ভূখন্ডকে বিভাজন করায় সৃষ্টি হয়েছে অনেক চরাঞ্চলের। এতে ৬ ইউনিয়নের মধ্যে উপজেলা শহর থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ৩টি ইউনিয়ন। ফলে প্রতিবছর বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়ে গৃহহীন হয় অসংখ্য পরিবার। চরাঞ্চল সমুহে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন দুর্যোগে কৃষি ফসল বিনষ্ট হওয়ায় কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো পড়ে যায় চরম সংকটে।
এমন পরিস্থিতিতে বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের শিকার ২৪০টি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার এবং একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশ। তারা দুর্যোগকালীন সময়ে ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তার পাশাপাশি পারিবারিক ভাবে আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মকান্ডে এগিয়ে এসেছে। আর তাদের সহযোগিতায় এসব পরিবার ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। সেই সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে তাদের জীবনমান।
জানা গেছে, ২০১৭সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশের ট্রান্সজিশনাল ফান্ড(এএসডি) প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় চালু করা হয় আয়বর্ধন মুলক বিভিন্ন কার্যক্রম। এর মধ্যে চলতি বছরে উপজেলার চরাঞ্চলীয় তিনটি ইউনিয়নের প্রায় ২৪০ পরিবারকে কৃষি ও প্রাণিসম্পদের উপর প্রশিক্ষণ দান, প্রশিক্ষণ শেষে ভেড়া প্রদান, শীতকালীন এবং গৃষ্মকালীন সবজির বীজ প্রদান, বস্তায় আদা চাষসহ সবজি চাষের উপকরণ ও জৈবসার করা হয়। প্রশিক্ষণ এবং বীজ ও সার সহায়তা পেয়ে বসতবাড়ীতে সবজি উৎপাদন করে নিজেদের পারিবারিক চাহিদা মিটানোর পর বাজারে বিক্রি করে বাড়তি আয় করে থাকেন তারা। এছাড়াও বিভিন্ন দুর্যোগকালীন সময়ে ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করে আসছে ওই উন্নয়ন সংস্থাটি।
সরেজমিনে উপজেলার নয়ারহাট ইউনিয়নের নাইয়ারচর এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশের ট্রান্সজিশনাল ফান্ড(এএসডি) প্রকল্পের আওতায় ওই গ্রামে ২১০শতাংশ জমির উপরে মাটি ভরাট করে প্রস্তুত করা হয়েছে একটি মনোরম গুচ্ছ গ্রাম। সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন ৩০টি নদী ভাঙ্গন কবলিত পরিবার। তাদের সুবিধার্থে সেখানে দেয়া হয়েছে একটি পুকুর, বিনোদনের জন্য একটি কমিউনিটি সেন্টার, একটি স্কুল, একটি স্যাটেলাইট ক্লিনিক, ৬টি টিউবওয়েল ও ৭টি ল্যাট্রিন।
এসময় ওই গ্রামের বাসিন্দা সালমা আক্তার জানায়, ফ্রেন্ডশিপের ট্রানজিশনাল ফান্ড প্রকল্প থেকে আমাকে ৪হাজার ১০০টাকা দিয়ে একটি ভেড়া প্রদান করেছে। সেটি থেকে বর্তমানে তার ৪টি ভেড়া হয়েছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য প্রায় ৩০হাজার টাকা। একই কথা বলেন ওই গ্রামের রাজমনি রাণী। একই গ্রামের রোসনা বেগম বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে শাক-সবজি উৎপাদনের প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর আমার বসতবাড়ীতে সবজি উৎপাদন করে এ বছর ২৫হাজার টাকার সবজি বিক্রি করেছি। যা আমার সংসারের বাড়তি আয় হিসাবে জমিয়েছি।
শাহিনুর বেগম বলেন, প্রকল্প থেকে কেঁচো সার তৈরীর প্রশিক্ষণ পেয়েছি। বর্তমানে আমার বসতবাড়ীতে কেঁচোসার উৎপাদন করছি এবং প্রতিমাসে ২হাজার টাকার কেঁচো সার বিক্রি করছি। শরিফা বেগম এর সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনি ফ্রেন্ডশিপের সহায়তায় ৩০টি বস্তায় আদার চাষ করেছেন এবং প্রতি বস্তায় ১থেকে দেড় কেজি আধা পাবেন বলে আশাবাদী। এ গ্রামের আরো অনেকেই বস্তায় আদা চাষ, সবজি ও ভার্মিকম্পোষ্ট উৎপাদন এবং ভেড়া পালন করে পরিবারের আয়বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। আবেদ আলী, জেনারুল হক, আবুল হোসেন ও আজগর আলীসহ অনেকে বলেন, আগে হাট থেকে রাসায়নিক সার কিনে আনতাম, এখন আমরা জৈব সার তৈরি করে ব্যবহার করি, ফেরোমন ফাঁদ দিয়ে পোকা মারছি, সরকারি সুযোগ সুবিধা পেতে বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করছি।
ফ্রেন্ডশিপ বাংলাদেশ এর ট্রান্সজিশনাল ফান্ড(এএসডি) প্রকল্পের রিজিওনাল ম্যানেজার কৃষিবিদ আশরাফুল ইসলাম মল্লিক জানান, প্রকল্পের সহায়তায় সদস্যদের আয় রোজগার নিয়মিতকরণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুশাসন এবং স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়নে এ বছর উপজেলায় ৩ইউনিয়নে ২৪০জনকে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
উপজেলা কৃষি অফিসার কুমার প্রণয় বিষাণ দাস জানান, ফ্রেন্ডশিপ প্রকল্পের পাশাপাশি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক উপকার ভোগীদের পূর্বের ন্যায় প্রশিক্ষণ প্রদানসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নে সর্বাত্নক সহযোগিতা করবে।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ সাগরিকা কার্জ্জী জানান, উপজেলায় ফ্রেন্ডশিপের ট্রানজিশনাল ফান্ড প্রকল্পের মাধ্যমে এ বছর ২৪০টি পরিবারকে ভেড়া প্রদান করেছে এবং প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ফলে পরিবারগুলোর ভেড়া পালনের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে অধিক আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেকটি ভেড়াকে টিকা এবং কৃমিনাশক বিনামূল্যে দেয়া হয়েছে। চর এলাকা ভেড়া পালনের জন্য উপযুক্ত তাই ভেড়া পালনের মাধ্যমে চরাঞ্চলের মানুষ স্বাবলম্বী হবে বলে আশা করছি।