বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) নেওয়া বিসিএসের ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার পদের ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় গ্রেফতার ১৭ জনের মধ্যে সাত জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে তারা বলেছেন, প্রশ্নপত্র চাকরিপ্রার্থীদের হাতে দেওয়া হতো না। পরীক্ষার আগের রাতে ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকায় নিরাপদ জায়গায় (চক্রের সদস্যদের ভাষায় বুথ) রাখা হতো। রাজধানীর পল্টনে একটি গোডাউনে চাকরিপ্রার্থীদের জড়ো করা হতো। সারা রাত প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করিয়ে সকালে পরীক্ষা দিতে পাঠানো হতো।
সর্বশেষ রেলওয়ের উপ-সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৬ জন প্রার্থীকে রাজধানীর পল্টনের একটি পানির ফিল্টারের গুদামে রাখা হয়েছিল। বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র এই চক্রটি ২০০২ সালে ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে শুরু করে সর্বশেষ ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও তারা ফাঁস করেছে। এর পাশাপাশি পিএসসির অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নন ক্যাডার পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তারা ফাঁস করেছে।
গতকাল ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আবেদ আলীসহ সাত জনের জবানবন্দিতে এমনই তথ্য বলা হয়েছে। ইতিমধ্যে এই ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গতকাল তাদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। তবে তাদের গ্রেফতারের পর পিএসসির একাধিক কর্মকর্তাসহ ১৪ জন গা-ঢাকা দিয়েছেন বলে সিআইডি সূত্রের খবর।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনায় নোমান সিদ্দিক ও আবেদ আলীসহ গ্রেফতার ১৭ আসামিকে গতকাল কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত। তাদের মধ্যে সাত জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দি দিয়ে কারাগারে যাওয়া আসামিরা হলেন—সৈয়দ আবেদ আলী, মো. খলিলুর রহমান, সাজেদুল ইসলাম, ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলেমান মো. সোহেল, মো. সাখাওয়াত হোসেন, সায়েম হোসেন ও বেকার যুবক লিটন সরকার। কারাগারে যাওয়া অন্য আসামিরা হলেন, পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক সদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান ও আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। এরআগে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে সরকারি কর্ম কমিশন আইনে ডিএমপির পল্টন থানায় মামলা দায়ের করে সিআইডি।
সংশ্লিষ্ট আদালত সূত্র জানায়, লক্ষ্মীপুরের রামগতি থানার চরআলগী গ্রামের মো. আবু তাহেরের ছেলে মো. নোমান সিদ্দিক এক সময় একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি করতেন। ২০০৪ সালে পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন চাকরির তদবির করতেন। তখন এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয় অর্থ বিভাগের অডিটর প্রিয়নাথ রায়ের সঙ্গে। প্রশ্নপত্র বিক্রি করে নোমান ঢাকার পাশেই একটি তৈরি পোশাক কারখানা দিয়েছেন। থাকেন মিরপুর ১০ নম্বরের সেনপাড়া পর্বতার ৪৫৮/৪ নম্বর ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটের মালিক তিনি নিজেই। অন্যদিকে, জিজ্ঞাসাবাদে প্রিয়নাথ রায় বলেছেন, যখন তিনি নোমান সিদ্দিকের সঙ্গে পরিচিত হন, তখন নোমান একটি বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালে দুই জনকে মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পাইয়ে দিতে নোমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তাদের মধ্যে একজন ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। এরপর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিয়োগে ভাইভার তদবির করেন। নোমান সিদ্দিক বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের প্রশ্নও ফাঁস করেছেন বেশ কয়েক বছর ধরে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মো. সাখাওয়াত হোসেন তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ৮ম শ্রেণি পাশ করা পানির ফিল্টারের ব্যবসায়ী সাখাওয়াতের পাসপোর্টে কানাডা ও ইংল্যান্ডের ভিসা রয়েছে। সাখাওয়াত জানিয়েছেন, টুরিস্ট ভিসায় কানাডা ঘুরে এসেছেন একবার। ইংল্যান্ডের ভিসা পেলেও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। দ্রুতই স্থায়ীভাবে কানাডা থিতু হতে চেয়েছিলেন। পল্টনের কার্লভাট রোডের ১৪১/২ নম্বর বাড়ির ২য় তলায় তার পানির ফিল্টারের গুদাম রয়েছে। ব্যবসায় সহযোগিতা করেন তারই আপন ভাই সিদ্ধেশ্বরী কলেজের ছাত্র সায়েম হোসেন। পিএসসির অফিস সহায়ক মো. সাজেদুল ইসলাম তার বন্ধু। এই সূত্রে দামি গাড়ি নিয়ে সাজেদুল প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করে চাকরিপ্রত্যাশী কেউ থাকলে জানাতে বলে। সাজেদুলের আফতাবনগরে নিজের ফ্ল্যাট রয়েছে। সবশেষ গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৬ জন প্রার্থীকে তার ঐ গুদামে রাখা হয়। রাতভর ঐ চাকরি প্রার্থীরা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মুখস্ত করে পরের দিন পরীক্ষা দিতে যান।
সাখাওয়াতের ভাই সায়েম তদন্তকারী সংস্থা সিআইডিকে জানিয়েছেন, সাজেদুল তাকে ফোন করে পল্টন থেকে দুই জন চাকরিপ্রত্যাশীকে রিসিভ করে গুদামে নিয়ে রাখতে বলে। তখন সে তাদের আনতে গেলে দেখে একটি মাইক্রো থেকে ৮ জন চাকরিপ্রত্যাশী নেমেছে। এভাবে ধাপে ধাপে ৪৬ জন চাকরিপ্রত্যাশীকে ঐ গুদামে নিয়ে যান তিনি।
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী গ্রেফতার লিটন সরকার জানিয়েছেন, গ্রেফতার জাহিদুল বৃহস্পতিবার দুই জন চাকরিপ্রত্যাশীকে শ্যামলী থেকে রিসিভ করতে বলেন। এরপর গভীর রাত হলেও জাহিদ কোনো যোগাযোগ করছিল না। একপর্যায়ে তাদেরকে একটি আবাসিক হোটেলে রাখতে বলে। পরে জাহিদ এসে ঐ চাকরিপ্রত্যাশীদের সঙ্গে দেখা করে।
আবেদের রয়েছে ৮০ কোটির সম্পত্তি : কুয়াকাটার হোটেল সান মেরিনাকে নিজের বলে দাবি করলেও সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী সেটির প্রকৃত মালিক নন। তিনি নিজের ফেসবুকে এটি নিয়ে পোস্ট করলেও হোটেল কর্তৃপক্ষ বলছে- আবেদ আলী নামে কাউকে তারা চেনেন না। এ নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে। তবে আবেদ আলীকে জিজ্ঞাসাবাদে অঢেল সম্পদের তথ্য পেয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। গ্রামে আলিশান বাড়ির পাশাপাশি ঢাকার পাইকপাড়ায় ছয়তলা বাড়ি, শেওড়াপাড়ার ওয়াসা রোডে একটি ৯ তলা ভবনে রয়েছে তিনটি ফ্ল্যাট। এই ভবনেরই পঞ্চমতলায় নিজের ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলেন আবেদ আলী। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোটা অঙ্কের টাকা রয়েছে। এ ছাড়া তার একটি গাড়ি রয়েছে। বিভিন্ন সময় সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে এসব অর্থ উপার্জন করেছেন আবেদ আলী। এসব অর্থ দিয়ে তিনি যেমন একদিকে বিলাসী জীবনযাপন করতেন, পরিবার নিয়ে তেমনি সামাজিক কাজেও এসব অর্থ ব্যয় করতেন।
প্রসঙ্গত, সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গত সোমবার পিএসসির দুই জন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী এবং তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম ফেসবুকে ভাইরাল হন। তাদের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলায়।