কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত ঘটনায় নীলদল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে চার দাবি পেশ করা হয়।
১ আগস্ট ( বৃহস্পতিবার) এক সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীলদলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. এম আমজাদ আলী এসব বিষয় তুলে ধরেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি ঢাবি নীলদল আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জনজীবনে অস্থিতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত ঘটনায় নীলদল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে অপ্রত্যাশিতভাবে শিক্ষার্থীসহ অনেকেই নিহত এবং আহত হয়েছেন, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রাণহানির ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীলদল গভীরভাবে শোকাহত এবং নিহতদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছে। একই সঙ্গে নিহতদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। পাশাপাশি যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি সহমর্মিতা এবং দ্রুত সুস্থতা কামনা করছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে যেকোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার সম্পর্কিত যৌক্তিক দাবিসমূহের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নীলদল বরাবরই ইতিবাচক অবস্থানে থেকেছে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই আন্দোলন শুরুতে শান্তিপূর্ণ থাকলেও পরবর্তীকালে সহিংস হয়ে ওঠে, যা গভীর উদ্বেগের। এই আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও রাজপথে স্বাধীনতা বিরোধী শ্লোগান উচ্চারণ করেছে, যা নিন্দনীয়।
শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি বিবেচনায় নিয়ে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের ২১ জুলাই ২০২৪ এর রায় কোটা সংস্কার দাবিকারী শিক্ষার্থীদের অনুকূলে হওয়ায় নীলদল সন্তুষ্টি প্রকাশ করছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার এই রায়কে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করায় নীলদল সরকারকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকা শিক্ষার্থী এবং তরুণ সমাজের কাঁধে ভর করে একশ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য প্রতিনিয়ত অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাথাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে দেশজুড়ে সাহংসতা, নেরাজ্য, হত্যাযজ্ঞ, সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ধ্বংস, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে কক্ষ ভাংচুর ও সম্পদের প্রভূত ক্ষতি সাধন এবং কারাগার আক্রমণের মতো রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্তরালে নাশকতাকারীরা মেট্রোরেল, বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, সেতু ভবন, বিআরটিএ, এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন ভবনে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকে মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেশ এবং রাষ্ট্রের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত করার ঘৃণিত চক্রান্তকে আমরা নিন্দা জানাই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই এর যৌক্তিক সমাধানে সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধানে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছে। আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা বিধান করতে গিয়ে নারী শিক্ষকসহ একাধিক শিক্ষক আহত হয়েছেন। লাঞ্ছিত হয়েছেন হল প্রভোস্টসহ আবাসিক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বরত শিক্ষকবৃন্দ।
ক্যাম্পাস পরিস্থিতি নিয়ে সোস্যাল মিডিয়ায় বস্তুনিষ্ঠ মতামত প্রকাশ করায় উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের একজন নারী শিক্ষককে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়েছে। শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সহিংসতায় আহত শিক্ষাথাদের সুচিকিৎসার প্রয়োজনায় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনার হাতে আটক অনেক শিক্ষার্থীকে ইতোমধ্যে মুক্ত করেছে। শিক্ষার্থীরা যাতে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলকে আহ্বান জানিয়েছে যা প্রশংসনীয়। প্রশাসনের এই সকল উদ্যোগে নীলদলের শিক্ষকবৃন্দ সক্রিয় সহযোগিতা প্রদান করেছে।
শিক্ষার্থীদের সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিরলস কাজ করছে। তথাপি একটি স্বার্থান্বেষী মহল সোস্যাল মিডিয়ায় শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষকদের বিপক্ষে দাঁড় করানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত; যা গভীর উদ্বেগের। নীলদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্যের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ-পদক্ষেপকে সাধুবাদ জানাচ্ছে।
নিপীড়ন বিরোধী বলে দাবি করা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় শিক্ষক ও বিএনপি-জামাত-এর রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত সাদা দলের শিক্ষকবৃন্দ কেবল একটি অংশের শিক্ষার্থীদের নিপীড়নের নিন্দা করেছেন। নির্যাতিত শিক্ষক ও প্রাণনাশের হুমকিপ্রাপ্ত শিক্ষকের ব্যাপারে তাদের কোনো উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা আমরা লক্ষ করিনি যা আমাদেরকে বিস্মিত করেছে। নীলদল দলমত নির্বিশেষে সকল শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছে।
আমরা মনে করি তরুণ প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালনার জন্য সরকারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে হবে। যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে যথাযথ সম্মান দেখিয়ে সুবিবেচনা এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে সমাধানের পথ নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি সরকার এই আন্দোলনে নিহত এবং আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার যে দ্বার উন্মোচন করেছে তা অব্যাহত রাখতে হবে।
নিরাপরাধ ব্যক্তিদের গ্রেফতার এবং হয়রানি না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া প্রাণহানির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের শান্তির আওতায় আনতে হবে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস ও অগ্নিসংযোগের সাথে জড়িত সকল অপরাধীর তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাবি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান:
এ আন্দোলন চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত সকল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের অবিলম্বে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
দ্রুততম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিত করে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে হবে। আবাসিক হলসমূহে বৈধ ও নিয়মিত শিক্ষার্থীদের অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
এসময় শিক্ষার্থীদের দাবির কাঙ্ক্ষিত সমাধান হওয়ায় তাদেরকে আন্দোলনের পথ পরিহার করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিতে ভূমিকা রাখা ও রাষ্ট্রদ্রোহী মহলের ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নকে পরিণত না হওয়ার ব্যাপারে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয়।