বিগত ১৫ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত মোবাইল অপারেটর টেলিটকে শুধু লুটপাটই করা হয়েছে হাজার কোটি টাকার উপরে। প্রতিষ্ঠানটিতে যারাই দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন তারাই অংশ নিয়েছেন লুটপাটে। যার কারণে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা থাকলেও কখনো উঠে দাঁড়াতে
পারেনি টেলিটক। বরং দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আরও মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশের বেসরকারি মোবাইল অপারেটরদের গ্রাহক সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও উল্টো চিত্র টেলিটকে। এর প্রধান কারণ টেলিটকের গ্রাহক সেবার মান সর্বনিম্ন। ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে রাষ্ট্রীয় মোবাইল অপারেটর টেলিটক। সেই সময় থেকে যতটা না সেবা দিতে পেরেছে তার চেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েছে এই সরকারি অপারেটর। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগের আঙ্গুল এই অপারেটরের দিকে। প্রতিষ্ঠানটির বেশির ভাগ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে মামলা হয়েছে। সেসব মামলার কোনোটা আদালতে বিচারাধীন অথবা কোনোটা দুর্নীতি দমন কমিশনের অধীনে তদন্তাধীন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, টেলিটকের এমন কোনো প্রকল্প নেই যেখানে অনিয়ম আর দুর্নীতি হয়নি। বরং দুর্নীতি করার জন্যই টেলিটকে নানা ধরনের প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে এই অপারেটরে হাজার কোটি টাকার বেশি লুটপাট হয়েছে। কিন্তু এসব নিয়ে অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হলেও তা নিষ্পত্তি হয়নি। কয়েকদিন দুদক নড়েচড়ে বসে ঢাকঢোল পিটিয়ে থেমে যায়। এসব কারণে যারা টেলিটকে দায়িত্ব নিয়ে আসেন তারা দুর্নীতি করতে সাহস পান।
এদিকে টেলিটকের গ্রাহক সেবার মান নিয়ে রয়েছে বিস্তর প্রশ্ন। পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলেই টেলিটকের অবস্থান স্পষ্ট হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন এর জুলাই মাসের গ্রাহক হিসেবে দেখা যায়, গ্রামীণফোনের গ্রাহক-৮৫ দশমিক ২৪ মিলিয়ন অর্থাৎ প্রায় সাড়ে আট কোটির বেশি, রবি আজিয়াটার গ্রাহক ৫৮ দশমিক ৯২ মিলিয়ন, বাংলালিংকের ৪৩ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিটকের গ্রাহক মাত্র ৬ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, টেলিটক নানাভাবে সরকারের দিক থেকে সুবিধা পেলেও ডিজিটাল দুর্নীতিতে মজে আছে শুরু থেকেই। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১৭ বছরে টেলিটক এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনেছে। আর গত কয়েক বছরেই টেলিটক লোকসান করেছে ৯৯৩ কোটি টাকা। কেনাকাটা থেকে শুরু করে নিয়োগ, পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দেয়া, পুরনো পদ্ধতির এসব লুটপাট তো রয়েছেই। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে নির্দিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি আমদানি কমিশন ও বিটিএস স্থাপনে বাড়ি ভাড়ার অনিয়ম। কাগজে-কলমে কেনা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে নেই, স্ক্র্যাচ কার্ড এবং ক্যাশ কার্ডের হিসাবে এমন কোটি কোটি গরমিলের প্রমাণ মিলেছে।
নির্দিষ্ট কিছু সিমের মাধ্যমে বৈধ কায়দায় অবৈধ আয়ের সুযোগ করে দেয়ার বিষয়টি দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে রীতিমতো আলোড়ন তুলেছে। টেলিটকের হাজার হাজার সিম দিয়ে অবৈধ ভিওআইপি করা হচ্ছে। সিম বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের পরও অবৈধ ভিওআইপিতে হাজার হাজার টেলিটকের সিম ধরা পড়ছে। এসব সিম দিয়ে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২ লাখ ৩০ হাজার মিনিট হারে অবৈধ ভিওআইপি কল করা হতো। এর আগে অনেক অভিযানে অবৈধ ভিওআইপিতে উদ্ধার করা সিমের মধ্যে টেলিটকের সিমই বেশি পাওয়া যেতো। ২০১৮ সালের নভেম্বরে টেলিটকের ৭৭ হাজার ৫৯০টি সিম বন্ধ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন। সিডিআর অ্যানালাইজার ও জিও-লোকেশন ডিটেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে ওই সিমগুলো বন্ধ করে দেয় বিটিআরসি। টেলিটকে কর্মরত একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ এসব দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই সময় গ্রামীণফোন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে সরকার এবং বিটিআরসিসহ নানা পর্যায়ে এ অভিযোগও করে যে টেলিটকের অবৈধ কার্যক্রমের জন্য তাদের আয়ের সুযোগ নষ্ট হচ্ছে। বিল জেনারেট করে কোটি কোটি টাকা নিজেদের অ্যাকাউন্টে জমা দেয়ার মতো অভিনব ঘটনা বাংলাদেশে টেলিটকই প্রথম দেখিয়েছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বর থেকে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত টেলিটকের কয়েকজন কর্মকর্তা মিলে কয়েক হাজার গ্রাহককে প্রতি মাসে তিনশ’ টাকা নিয়ে তাদের অবিরাম কথা বলার সুযোগ দেন।
এতে টেলিটক কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন ছিল না। এর মাধ্যমে অন্তত ১৬ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এ সম্পর্কিত অডিট প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কাগজপত্রে থাকলেও বাস্তবে টেলিটকের ভাণ্ডারে কোটি কোটি টাকার সিম কার্ড এবং স্ক্র্যাচ কার্ডের হদিস নেই। টেলিটকের লেজার এবং অন্যান্য হিসাবে মজুত দুই ধাপে ৩১ কোটি টাকার বিভিন্ন মূল্যমানের স্ক্র্যাচ কার্ড এবং ক্যাশ কার্ড ঘাটতি রয়েছে। একইভাবে ৪৩ হাজার ২৭১টি সিম কার্ডে মজুত ঘাটতির ফলে কোম্পানি ক্ষতির পরিমাণ আরও ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯ টাকা। অন্যদিকে থ্রিজি প্রকল্প নিয়ে টেলিটক সবচেয়ে বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছে। চায়নার এক্সিম ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয়া এবং নির্দিষ্ট দুটি কোম্পানির কাছ থেকে কেবল পণ্য কেনার ক্ষেত্রে বেশি অনিয়ম হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সে সময় কোনো স্থান নির্ধারণ না করেই যত্রতত্র নির্বিচারে সাইনবোর্ড-বিলবোর্ড দিয়ে বিপণন বিভাগের কর্মকর্তারা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। বিজ্ঞাপন প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাহীন পক্ষপাতিত্বের আশ্রয় নেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রসঙ্গে টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নুরুল মাবুদ চৌধুরীকে একাধিকবার টেলিফোন করা হলে তিনি ধরেননি। এদিকে টেলিটকের সার্বিক করুন অবস্থা দেখে এর সংস্কারে ১০ দফা প্রস্তাব পেশ করে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন।
তারা জানায়, যাত্রা শুরুর পর থেকে টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড দেশের আপামর জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি। তুলনামূলক কম কলরেট ও ডাটা রেট থাকার পরও বিটিআরসি’র মাসিক গ্রাহক সংখ্যার পরিসংখ্যান অনুসারে ৬৫ লাখ গ্রাহক রয়েছে যা অন্যান্য প্রাইভেট অপারেটরের তুলনায় খুবই কম। এত কম গ্রাহক নিয়ে টেলিটক ব্যাবসায়িকভাবে টেকসই অবস্থানে যেতে পারবে না। আমাদের দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণে দেখতে পারি, টেলিটকের টাওয়ার সংখ্যা ৬০০০ এর মতো আর পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সরকারি মালিকানাধীন মোবাইল অপারেটর রয়েছে যেখানে অন্য অপারেটরদের টাওয়ার সংখ্যা ১৫০০০ এরও বেশি। সীমিত ফোর-জি কাভারেজ, মাঠপর্যায়ে সেলস কার্যক্রমের উদাসীনতা, গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মাধ্যমে মার্কেটিং কার্যক্রম অনুপস্থিত, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো ও স্বচ্ছতার অভাব, বিগত রাজনৈতিক সরকারের টেলিটক নিয়ে নেতিবাচক মনোভাবের কারণে টেলিটকের দেশের মানুষের চাহিদা পূরণে সফল হতে পারেনি। আপামর মোবাইল গ্রাহকদের স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে, মোবাইল গ্রাহক এসোসিয়েশন মনে করে যে, বৈষম্যহীন স্বাধীন বাংলাদেশে টেলিটকের সেবার মান বাড়ানো ও গ্রাহকদের কম খরচে মোবাইল সেবা প্রদান করার জন্য টেলিটকের আমূল সংস্কার করা প্রয়োজন।
এর আগে বাংলাদেশ সরকার ৪টি লক্ষ্য নিয়ে টেলিটক প্রতিষ্ঠা করে। এসবের মধ্যে রয়েছে-দেশের জনগণকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোবাইল টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান করা, প্রাইভেট ও পাবলিক সেক্টরের মধ্যে সুস্থ বাজার প্রতিযোগিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করা, মোবাইল টেলিফোন নেটওয়ার্কের সুবিধাবঞ্চিত দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে যেমন হাওর অঞ্চল, দ্বীপাঞ্চল, পার্বত্য ও উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণকে টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান করা ও সরকারের রাজস্ব আহরণের নতুন উৎস সৃষ্টি করা। কিন্তু টেলিটক ওই চার লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি করেছেন দেশের টেলিকম বিশেষজ্ঞরা। তবে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ প্রসঙ্গে টেলিটক জানিয়েছে, দ্রুত বর্ধনশীল মোবাইল টেলিযোগাযোগ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে টেলিটক নিয়মিত নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করে চলছে। নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও ইতিমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলা, ৪০২টি উপজেলাসহ বেশির ভাগ হাইওয়ে টেলিটকের কাভারেজের আওতায় এসেছে। এ ছাড়া দেশের প্রত্যন্ত ও দুর্গম হাওর, দ্বীপাঞ্চল, উপকূলীয় ও পার্বত্য অঞ্চলে টেলিটকের নেটওয়ার্ক স্থাপন এবং বিদ্যমান নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণের কাজ চলছে। ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর কোম্পানি আইন-১৯৯৪ এর অধীনে দুই হাজার কোটি টাকা অনুমোদিত মূলধন নিয়ে টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড একটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধিত হয় এবং উক্ত তারিখেই টেলিটক ‘কমেন্সমেন্ট অব বিজনেস’ সার্টিফিকেট অর্জন করে। ২০০৫ সালের ৩১শে মার্চ টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেড এর ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়।
সুত্র:মানবজমিন