ঢাকা
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
বিকাল ৪:২৫
logo
প্রকাশিত : অক্টোবর ১৩, ২০২৪

গ্রামীণ ব্যাংক কেন কর অব্যাহতি পেল

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংককে ২০২৯ সাল পর্যন্ত কর অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ বছরের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের অর্জিত সব আয়কে আয়কর প্রদান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।

এনবিআরের এই প্রজ্ঞাপনের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটি নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো গ্রামীণ ব্যাংক কি এই প্রথম এমন করমুক্ত সুবিধা পেয়েছে?

জবাবে এনবিআরের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে নিঃশর্তভাবে কর মওকুফ সুবিধা পেয়ে থাকলেও ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে এ সুবিধা বন্ধ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।

এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে অন্য যারা কাজ করে তারাও একই ধরনের সুবিধা পায়। গ্রামীণ ব্যাংকেরটা যেহেতু বাদ হয়ে গিয়েছিল আমরা একই ফর্মুলায় সেটি এখন ঠিক করে দিলাম। এটা ন্যায্যতা ও সমতা।

একই শর্তে ২০২৯ সালের জুন পর্যন্ত দানকৃত আয় থেকে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে অলাভজনক দাতব্য সংস্থা আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনকে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষুদ্র ঋণ, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কাজ কিংবা বিদেশি কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকিয়ে রাখতে সরকার বিভিন্ন সময় আইন অনুযায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে কর সুবিধা দিয়ে থাকে।

অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এটা আইনের মধ্যে না থাকলে অধ্যাপক ইউনূসের সাথে বিগত সরকারের যে টানাপোড়েন ছিল তারা কখনো ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংককে কর অব্যাহতি সুবিধা দিত না।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত সরকারের নীতিগত অবস্থান ও আইনের ব্যাখ্যাগত কিছু অস্পষ্টতা থাকার কারণে গ্রামীণ ব্যাংকের এই সুবিধা আর নবায়ন করা হয়নি।

গ্রামীণ ব্যাংককে কর অব্যাহতি দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয় ‘আয়কর আইন ২০২৩ এর ধারা ৭৬ এর উপধারা (১) এর ক্ষমতাবলে, গ্রামীণ ব্যাংক আইন, ২০১৩ এর ধারা ৪ এর অধীন স্থাপিত গ্রামীণ ব্যাংকের অর্জিত সকল আয়কে এই আইনের অধীন আয়কর প্রদান হতে অব্যাহতি প্রদান করা হলো।’ এর এই কর অব্যাহতির মেয়াদ থাকবে ২০২৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত।

গত ৫ অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ৮ অগাস্ট শপথ নেয় অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পরে গত ২৭ অগাস্ট কর অব্যাহতি চেয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এনবিআরকে চিঠি দেওয়া হয়। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে ২৫ সেপ্টেম্বর এনবিআরের বোর্ড সভায় গ্রামীণ ব্যাংককে কর অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক নামে ব্যাংক, আসলে তারা ক্ষুদ্রঋণ অপারেশনই করে। আমাদের আইনে মাইক্রোক্রেডিট অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যারা কাজ করে তাদের ক্ষেত্রে কর অব্যাহতি আছে। এটা অন্য সবার জন্যও আছে।

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক রাজস্ব কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক কিছু বিবেচনা করে গ্রামীণ ব্যাংককে শুরু থেকেই কর অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে আসছিল। তার মধ্যে অন্যতম একটা কারণ ছিল এই ব্যাংকটি তৈরিই হয়েছিল দারিদ্র দূরীকরণ ও নারী ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে।

সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, গ্রামীণ ব্যাংক শুরু থেকে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য তৈরি হয়েছিল। ইটস দেয়ার ব্যাংক। যেহেতু এটা দরিদ্র ও নারীদের কল্যাণে কাজ করছে, এই প্রতিষ্ঠান তো কর রেয়াত পাবেই।

ক্ষুদ্রঋণের পাশাপাশি শিক্ষাঋণ, গৃহঋণ, ভিক্ষুকদের ঋণ দেওয়ার মতো কিছু সামাজিক কাজও করে গ্রামীণ ব্যাংক।

কর অব্যাহতি নিয়ে আইন কী বলছে?

বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর আইন অনুযায়ী কারা কারা আয়কর অব্যাহতি সুবিধা পাবেন সেটি নিয়ে অনেকগুলো ধারা রয়েছে। তবে এটি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ব্যবসায় কী কী ধরনের খাত বা প্রতিষ্ঠান আয়কর অব্যাহতির সুযোগ পেতে পারেন সেটি নিয়ে তিনটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মি. মজিদ। তিনি বলেন, প্রথমত কোনো প্রতিষ্ঠান যদি সামাজিক বা কল্যাণমূলক কাজের সাথে জড়িত থাকে তাহলে তারা এই আয়কর অব্যাহতি পায়। দ্বিতীয়ত কৃষি মৎস্য চাষ বা স্থানীয় শিল্প সুরক্ষায় যদি কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করে তারা কর অব্যাহতি পেতে পারে। তৃতীয়ত, কোনো প্রতিষ্ঠান যদি দেশে সাবলম্বী শিল্প প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠতে চায়, সেক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানির সাথে যেন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে সেক্ষেত্রে কর অব্যাহতি দেওয়া হয়।

তার মতে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের কথা চিন্তা করে সরকার এই ধরনের পদক্ষেপগুলো নিয়ে থাকে।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে কারা আয়কর অব্যাহতি পাবেন আর কারা পাবে না সেটি নিয়ে আইনের কিছু ব্যাখ্যাগত অস্পষ্টতা রয়েছে। একেক সময় একেক সরকার এটিকে ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যবহার করেছে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ও অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, সুস্পষ্ট আইনের ভেতর না থাকার কারণে অনেক সময় অনেক প্রতিষ্ঠান এই করমুক্ত আয় সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরে তাদের অনেকে ট্রাইব্যুনালে গিয়ে সুবিধা পেয়েছে।

শুরু থেকেই কর অব্যাহতি পেতো গ্রামীণ ব্যাংক

১৯৮৩ সালে সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার পর থেকে সব সময়ই কর অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছিল গ্রামীণ ব্যাংক। গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের ৩৩ ধারার আওতায় সুবিধা পাচ্ছিল তারা। ২০১৩ সালে অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করা হলেও ওই ধারা অব্যাহত থাকে।

গ্রামীণ ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক বছর পরপর এনবিআর প্রজ্ঞাপন জারি করে কর অব্যাহতির মেয়াদ নবায়ন করে আসছে। সর্বশেষ ২০১১ সালের জুলাই ওই প্রজ্ঞাপন জারি হয়।

মেয়াদ শেষের আগেই তখন নবায়নের আবেদন করা হয়েছিল গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে। পরে এ নিয়ে কয়েক দফায় বৈঠক ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার পর, ২০১৬ সালের মে মাসে আয়কর রিটার্ন দাখিলের শর্তে ২০২০ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকের কর অব্যাহতি সুবিধা পায় গ্রামীণ ব্যাংক। পরে ২০২১ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে আয়করমুক্ত এ সুবিধা বন্ধ হয়ে যায় গ্রামীণ ব্যাংকের।

অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে অধ্যাপক ইউনূসের টানাপোড়েন তৈরি হয় ২০১০-১১ সালের দিকে। আইনে যদি না থাকতো তাহলে তো তখনই এই সুযোগ বাতিল করে দিতো সরকার।

সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান মি. মজিদ বলেন, গ্রামীণ ব্যাংককে কর রেয়াত দেয়ার বিষয়টি শুরু থেকে থাকলেও ২০২১ সালের পর কেন সেটি দেয়া হয়নি, সেই প্রশ্ন বিগত সরকারই ভালো বলতে পারবে।

এবার যে কারণে এত আলোচনা

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান অধ্যাপক ইউনূস শুরু থেকে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে অধ্যাপক ইউনূস যখন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, তখন তার সাথেই একই পুরস্কার জয় করেছিল গ্রামীণ ব্যাংকও।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে টানাপোড়েন শেষে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার দুই মাসের মাথায় আবারও এই সুবিধা পেয়েছে ক্ষুদ্র ঋণ ও দারিদ্র বিমোচন নিয়ে কাজ করা এই ব্যাংকটি।

২০২৯ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিকে কর অব্যাহতি দেওয়ার পর এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে।

এ নিয়ে এনবিআরের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ২০২১ সাল থেকে যে কারণে বাদ দেয়া হয়েছে সেই কারণ আমরাও জানি না। তবে যে কারণেই বাদ পড়ুক আমরা আইন অনুযায়ী এটি করেছি। ২০২৯ সাল পর্যন্ত আমরা তাদের এই সুবিধা দিচ্ছি যেহেতু তারা মাইক্রোক্রেডিট নিয়ে কাজ করে অন্যদের মতোই।

একই দিন আলাদা প্রজ্ঞাপনে আয়করমুক্ত সুবিধা পায় অলাভজনক ধর্মীয় দাতব্য সংস্থা আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনও। গ্রামীণ ব্যাংককে আয়কর অব্যাহতি দেওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা তৈরি হলেও আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন নিয়ে এ ধরনের আলোচনা লক্ষ্য করা যায়নি।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিভিন্ন সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অর্গানাইজেশনকে জনকল্যাণমূলক কাজের কারণে যে কর অব্যাহতি দেয় সেটা বর্তমান আইনের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে না থাকায় অনেকে অনেকভাবে আলোচনা করছে। এটা আইনে স্পষ্ট থাকলে হয়তো এভাবে আলোচনা হতো না।

logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram