বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) মনে করে, বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাধা। গতকাল ‘বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ সংস্কার: অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডা’ শীর্ষক সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি। এতে শেখ হাসিনার শাসনামলে পরিচালিত এক জরিপে ব্যবসায় বড় দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুনে পরিচালিত জরিপে আরও বেশ কয়েকটি সমস্যা উঠে এসেছে। সেগুলো হলো- অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, দুর্বল জনস্বাস্থ্য, অপরাধ ও চুরি এবং শ্রমবাজারে নৈতিকতার অভাব। সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ব্র্যাক সেন্টারে এ সংলাপে জরিপের ফলাফল তুলে ধরে বলেন, বিগত সরকারের আমলে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশে সীমিত অগ্রগতি দেখা গেছে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম কয়েকটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি ছিল।
সিপিডি জানিয়েছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে প্রায় ১৭ শতাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিকে তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ডলারের বিনিময় হারে অস্থিরতাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ হিসাবে ধরা হয়েছে। এরপর আছে অদক্ষ সরকারি আমলাতন্ত্র, মূল্যস্ফীতি ও মূলধন পাওয়ার সীমিত সুযোগ। আগামী দুই বছরে দেশের অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা এবং দারিদ্র্য ও বৈষম্য অর্থনৈতিক- এই তিন ধরনের ঝুঁকিতে থাকবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি প্রবন্ধে বাংলাদেশে ডুয়িং ব্যবসা করার জন্য ১৭টি সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে- দুর্নীতি, আমলাতন্ত্রের অদক্ষতা, বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি, আর্থিক সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, নীতির অস্থিতিশীলতা, দুর্বল শ্রমশক্তি, শিক্ষিত শ্রমশক্তির অপ্রতুলতা, উচ্চ কর হার, ট্যাক্স প্রবিধানের জটিলতা, জলবায়ু পরিবর্তন, অপরাধ ও চুরি, উদ্ভাবনের জন্য অপর্যাপ্ত ক্ষমতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ঝুঁকিপূর্ণ জনস্বাস্থ্য এবং শ্রমনীতির সীমাবদ্ধতা।
সিপিডি’র মতে, ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার মানদণ্ডে শ্রীলঙ্কা ও ভারতের চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া অর্থনীতির তুলনায় ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায়ও অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নীতি, আইন, প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমে উল্লেখযোগ্য সংস্কারের অভাব অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায়িক পরিবেশ গড়ে ওঠার বিষয়টিকে বাধাগ্রস্ত করছে।
তিনি বলেন, আমরা মনে করি দুর্নীতি সর্বদাই প্রধান সমস্যা। যদিও অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর সমস্যা ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। বছরের পর বছর ধরে অদক্ষ আমলাতন্ত্র আরেকটি প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামপ্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা একটি কারণ হয়ে উঠেছে। মুদ্রাস্ফীতি সব সময় বড় চিন্তার কারণ। অন্যদিকে নীতির অস্থিতিশীলতা একটি মাঝারি স্তরের সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
সংলাপে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার (উপদেষ্টা) আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত অধ্যাপক লুৎফে সিদ্দিকী প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সভাপতিত্ব করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন। এ ছাড়া অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু, এফআইসিসিআইয়ের সভাপতি জাভেদ আখতার, বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, ডিসিসিআই’র সভাপতি আশরাফ আহমেদ ও বিটিএমএ’র সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল উপস্থিত ছিলেন।
সিপিডি পরিচালিত এক্সিকিউটিভ ওপেনিয়ন সার্ভে (ইওএস) প্রতিবেদনে উঠে আসা জরিপটি করা হয় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সহায়তায়। জরিপে তথ্য সংগ্রহ করা হয় গত এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে। এতে সেবা খাত, শিল্প ও কৃষি খাতের দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীরা তাদের মতামত দেন। দেশে ব্যবসা পরিচালনায় ঘুষ লেনদেন আরও বেড়েছে। ৫৭ শতাংশের বেশি ব্যবসায়ী মনে করেন, কর সংক্রান্ত সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয়। আগের বছর এ অভিযোগ ছিল ৪৭.৮ শতাংশ ব্যবসায়ীর। জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বৈশ্বিক ব্যবসায় প্রতিযোগিতা সূচকে নাজুক অবস্থায় পড়া বাংলাদেশকে টেনে তুলতে ‘রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন’ গঠনের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ফিকি) সভাপতি জাভেদ আখতার বলেন, মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হবে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডের প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। বাণিজ্য বাড়াতে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, দুর্নীতি ও ঘুষ চক্র থেকে উত্তরণের উপায় বের করতে হবে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, ১০০ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের লক্ষ্য থেকে সরকার সরে আসছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য অর্থনৈতিক অঞ্চলের সংখ্যা ৫ অথবা ১০টি হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, প্রয়োজনে বিজনেস রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন গঠন করা হবে। সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত স্বার্থের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা সরকারের কাজের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনছি। আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী ও বিধ্বংসী প্রতিষ্ঠান বলে মন্তব্য করে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বৈরাচারী আচরণ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ধ্বংস করার জন্য দায়ী। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এখন দরকার সব ধরনের স্বেচ্ছাচারী নীতিমালা দূর করা। এসব নীতিমালার কারণে যেসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদেরকে এই নীতিমালা সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত করা দরকার।