ঢাকা
৫ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
রাত ১:৩৬
logo
প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৪, ২০২৪

১৩ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট

নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও দেশে দীর্ঘদিন ধরে নোট-গাইড বইয়ের রমরমা ব্যবসা চলছে। অবৈধ এই ব্যবসা করে গত ১৩ বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। সৃজনশীল মেধা বিকাশ নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালে হাইকোর্ট বিভাগের এক আদেশে নোট বইয়ের পাশাপাশি গাইডও নিষিদ্ধ করা হয়। আইনটি লঙ্ঘনের দায়ে সর্বোচ্চ সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। তারপরও গত ১৩ বছর দুর্দান্ত প্রতাপের সঙ্গে কয়েকটি ছাপাখানার মালিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সব শ্রেণির ‘একের ভেতর সব’ নাম দিয়ে তৈরি গাইড-সহায়ক বই ছাপিয়ে প্রকাশ্যে বাজারজাত ও বিক্রি করেছে।

অবৈধ গাইড বই কোম্পানিতে গোপনে মাসিক বেতনে চাকরি করছেন বিসিএস সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা ক্যাডারের পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা। তারা এসব কোম্পানির নোটবই লেখার কাজ করেন।

এনসিটিবির তিন জন কর্মকর্তা জানান, একশ্রেণির ইউএনও, জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, স্থানীয় বিভিন্ন শিক্ষক সমিতির সহযোগিতায় প্রকাশকরা নোট-গাইড বইয়ের বাণিজ্যে লিপ্ত। খোদ রাজধানীতে এই ধরনের বাণিজ্য টিকিয়ে রেখেছে এনসিটিবি ও শিক্ষা অধিদপ্তরের একশ্রেণির কর্মকর্তা। কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কোনো নজির নেই।

প্রতি বছর পয়লা জানুয়ারিতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে সরকার থেকে পাঠ্যবই দেওয়া হয়। এনসিটিবির অনুমোদন ব্যতীত পাঠ্যতালিকায় অন্য কোনো বই ব্যবহার করা যাবে না মর্মে বিধান রয়েছে। তার পরও কে শোনে কার কথা। বরাবরের মতো এবারও বিনা মূল্যের পাঠবই মুদ্রণের আগেই বাজারে আসতে শুরু করেছে সরকার নিষিদ্ধ বিষয়ভিত্তিক বিভিন্ন কোম্পানির নোট ও গাইড বই। যদিও মূল বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছানোর আগে পাঠ্যবইয়ের কোনো বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) বাইরের কারোরই জানার বা দেখার সুযোগ নেই। তা সত্ত্বেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বইয়ের সিডি (মুদ্রণের ‘র’ কপি), নম্বর বণ্টন ও সিলেবাসের আগাম তথ্য মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে নোট গাইড ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রেস মালিকদের হাতে চলে গেছে। এই প্রেস মালিকরা মূল পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ বাদ দিয়ে এখন ‘সহায়ক বই’ নামের নোট-গাইড বই ছাপানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ফলে সময়মতো ৪১ কোটি পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

সূত্র জানায়, এনসিটিবির কর্মকর্তারা সম্প্রতি দুটি ছাপাখানা পরিদর্শনে গিয়ে নোট-গাইড বই ছাপানোর বিষয়টি হাতেনাতে ধরেছে। তাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা খাত ধ্বংসের এমন অপকর্মে জড়িত পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নোট-গাইড প্রকাশকদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ বি এম রিয়াজুল হাসান সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, অসৎ কাজের জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করতে ইতিমধ্যে একাধিক কমিটি গঠন করেছে এনসিটিবি।

পাঠ্যবই ছাপার বড় ঠিকাদারদের নোট-গাইড কোম্পানি রয়েছে: জানা গেছে, গত ১৩ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সম্পাদনা শাখা থেকে পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি, নম্বর বণ্টন ও সিলেবাসের আগাম তথ্য নোট-গাইড প্রকাশকদের কাছে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে হস্তান্তর করা হচ্ছে। যারা পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি পায়, তাদের মধ্যে বড় ঠিকাদারদের নোট-গাইড কোম্পানি রয়েছে। আগাম তথ্য সংগ্রহ করে নোট-গাইড লিখে ও প্রকাশ এবং বাজারজাত করে প্রতি বছর দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি বাণিজ্য করছে কয়েকটি কোম্পানি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২২ সাল থেকে নতুন কারিকুলাম চালু হওয়ার পর নোট ও গাইড বই ব্যবসার সুযোগ কিছুটা কমে আসে। কেননা বিতর্কিত ঐ কারিকুলামে (২০২২ সালের) শিক্ষার্থীদের খুব একটা পড়াশোনা করতে হতো না। ফলে গত তিন বছর মাধ্যমিকের বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের নোট বা গাইড বই বিক্রি কিছুটা কম হয়েছে। তারপরও বাজারে সয়লাভ ছিল গাইড বই। বিক্রি হয়েছে, তবে তুলনামূলক কম। কিন্তু আগামী ২০২৫ সাল থেকে নতুন করে সৃজনশীল প্রশ্নে পরীক্ষাপদ্ধতি চালু হওয়ার খবরে নোট ও গাইড বই বাজারে নিয়ে আসার কাজে ব্যস্ত এখন পুস্তক ব্যবসায়ীরা।

অভিযোগ রয়েছে, যারা পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি পেয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশ কিছু বড় বড় ঠিকাদারের নোট-গাইড কোম্পানিও রয়েছে। ছয়টি প্রেসে একই সঙ্গে বৈধ ও অবৈধ বই ছাপানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে মাধ্যমিকের বিভিন্ন ক্লাসের একাধিক গাইড ও নোট বই বাজারে চলেও এসেছে। গত তিন বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার গাইড বই বিক্রি করে ৪ হাজার কোটি টাকা আয় করার টার্গেট রয়েছে তাদের।

একশ্রেণির শিক্ষক সরকারি কাজের চেয়ে বেশি ব্যস্ত গাইড বই লেখায়: অবৈধ নোট-গাইড কোম্পানিতে গোপনে মাসিক বেতনে চাকরি করছেন বিসিএস সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষা ক্যাডারের পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা। কখনো অফিস বা স্কুল-কলেজ সময়ের পর তারা এসব কোম্পানির অফিসে বসে নোটবই লেখার কাজ করেন। আবার শিক্ষা অধিদপ্তর বা এনসিটিবির বড় পদে চাকরিরত একশ্রেণির কর্মকর্তাদের অবৈধ সুবিধা দিয়ে থাকেন গাইড বই মালিকরা। অবসরের পর ঐ সব কোম্পানিতে তারা চাকরি শুরু করেন। জানা গেছে, নোট-গাইড কোম্পানিগুলোর মালিকদের টার্গেট প্রেষণে অথবা বদলিভিত্তিক পদায়ন পাওয়া জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর এবং মাদ্রাসা ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা। এছাড়া শিক্ষা ক্যাডারদের শিক্ষা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে তদবির করে পদায়ন পাইয়ে দিতেও ভূমিকা রাখতে পারেন কোনো কোনো নোট-গাইড কোম্পানির মালিক।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘুষ প্রদানে ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ: ছাপাখানার মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে নভেম্বর ও ডিসেম্বর সহায়ক বইয়ের নামে বিক্রি হওয়া ‘নিষিদ্ধ নোট-গাইড’ বইয়ের মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে খোলাবাজারে এই ধরনের নিষিদ্ধ বইয়ের বিক্রি ঠেকাতে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসবই ছিল লোক দেখানো। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ছাপাখানার মালিক বলেন, ‘চলতি মাসের জন্য নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই ছাপা বন্ধে কঠোর নজরদারি করা উচিত। কারণ তারা চড়ামূল্যে কাগজ কিনে মিলগুলোকে ব্যস্ত রাখছেন। এজন্য ন্যায্যমূল্যে আমাদের কাগজ দিতে গড়িমসি করছে মিলগুলো। এতে আমরা সরকারি পাঠ্যপুস্তক ছাপাতে নানা রকম প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছি।’

জানা গেছে, গাইড বইয়ের বিক্রি বাড়াতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘুষ প্রদান বাবদ এবার ৫০ কোটি টাকা বাজেট করেছে গাইড বই কোম্পানিগুলো।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram