এম খোরশেদ আলম, পীরগাছা (রংপুর) প্রতিনিধি: ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখতেন মানুষের জন্য কিছু করার। ইচ্ছে ছিল নিজের সামর্থ্যের মধ্যেই করা, তবে শুধু স্বপ্ন দেখেই থেমে যাননি, সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলোর ভবিষ্যৎকে বানিয়েছেন নিজের স্বপ্ন। আর সেই অধরা স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখার বাসনা থেকেই নিজের একটি সংগঠন তৈরি করেন, নাম দিয়েছেন ‘চলো স্বপ্ন ছুঁই’। নামের মাঝেই যেন কাজের উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। সংগঠনের নামকরণের গল্পটি এমনই। বলছি, ‘চলো স্বপ্ন ছুঁই’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মুহতাসিম আবশাদ জিসান এর কথা। রংপুর জেলার পীরগাছা উপজেলার স্বনামধন্য ডাক্তার পরিবাররের মরহুম ডা. সামসুল হক এর নাতি এবং আবু হেনা মোঃ শাহনেওয়াজ ফুয়াদের এর বড় ছেলে মোঃ মুহতাসিম আবশাদ জিসান। পড়াশুনা করছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনে। সংগঠনের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষায় যেমন কাজ করে যাচ্ছেন , তেমনিভাবে সমাজের অসহায় মানুষদের মানবিক সাহায্যদানের কাজটিও করছেন সমানতালে।
শৈশবের অনুপ্রেরণা ও স্বপ্নের শুরু:
জিসানের স্বপ্নের যাত্রা শুরু হয় শৈশবেই। ছোটবেলায় টেলিভিশনে স্বেচ্ছাসেবকদের বন্যার্তদের সাহায্য করতে দেখতেন এবং তখন থেকেই তার মনে ইচ্ছা জাগে মানুষের জন্য কিছু করার। রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির কার্যক্রম তাকে প্রচণ্ড অনুপ্রাণিত করে। ২০১২ সালে তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির রংপুর ইউনিটে যোগ দেন এবং বিভিন্ন কর্মশালা ও কার্যক্রমে অংশ নেন। এই সময় থেকেই তার মধ্যে দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা জাগে।
"চলো স্বপ্ন ছুঁই" এর প্রতিষ্ঠা:
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে, একজন প্রতিবন্ধী অসহায় মহিলার দায়িত্ব নেওয়ার মাধ্যমে জিসান তার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন। ত্রিশ জন সদস্য নিয়ে "চলো স্বপ্ন ছুঁই" এর যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে এই সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা ৪৫০ এরও বেশি এবং এটি উত্তরবঙ্গের সাতটি জেলায় কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
বিভিন্ন উদ্যোগ ও প্রভাব:
"চলো স্বপ্ন ছুঁই" এর কার্যক্রম পাঁচটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (ঝউএ) অধীনে পরিচালিত হয়: সব ধরণের ফুড রিলিফ এসডিজি ২ জিরো হাঙার প্রজেক্ট। নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে এসডিজি ৩ এর আওতাধীন তাদের প্রজেক্টঃ অপরাজিতা। সবার জন্য শিক্ষা, এতিম অর্থাভাবে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের আগামীদিনের ভবিষ্যৎ হিসেবে গড়ে তুলতে এসডিজি ৪ এর আওতাধীন প্রজেক্টঃ আলোকিত বাংলাদেশ। সমাজের অসহায় নারী, অসহায় মানুষদের কর্মক্ষম করে তুলতে এসডিজি ৮ এর আওতাধীন প্রজেক্টঃ স্বপ্নপূরণ। পরিবেশকে সবুজে ছেয়ে দিতে, পরিবেশ রক্ষার্থে এসডিজি ১৩ আওতাধীন প্রজেক্টঃ ক্লাইমেট অ্যাকশন।
২০১৯ সালে তাদের প্রথম বড় ইভেন্ট ছিল, যেখানে ৬৭ জন ছিন্নমূল শিশুকে শিক্ষা উপকরণ, নতুন পোশাক এবং খাবার বিতরণ করা হয়। করোনাকালে তারা ৭৫০০ পরিবারের মাঝে খাদ্য ও অর্থ সহায়তা প্রদান করে এবং ৩৫০০০ মাস্ক বিতরণ করে। এছাড়াও প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার প্রদান, কর্মক্ষম মানুষের আয়ের পথ সৃষ্টির জন্য হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু, সেলাই মেশিন প্রদানের কাজ করছে "চলো স্বপ্ন ছুঁই"। এখন পর্যন্ত ১৫৭ টি পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে পেরেছে চলো স্বপ্ন ছুঁই।
ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতি:
জিসান শুধুমাত্র তার সংগঠনের কাজেই সীমাবদ্ধ থাকেন না। তিনি নিয়মিত রক্ত দান করেন এবং এখন পর্যন্ত আঠারো বার রক্ত দান করেছেন। চলো স্বপ্ন ছুঁই এর পাশাপাশি জিসান আমেরিকার প্রবাসীদের একটি সংগঠন নারিশ বাংলাদেশ এর স্বেচ্ছাসেবক হয়েও বাংলাদেশ থেকে কাজ করছেন। স্বেচ্ছাসেবী কাজ করতে গিয়ে বিগত চার বছরে পরিবার ছাড়া ৭ টি ঈদ করেছেন। অন্যান্য বছরের ন্যায় এইবছরেও ঈদুল আযহাতে নারিশ বাংলাদেশের কুরবানি প্রোগ্রাম আয়োজন করে, যেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের নেতৃত্ব দিয়ে ১০০০ মানুষের কাছে কুরবানির মাংস পৌঁছে দেই আমরা ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দিয়ে তাদের মুখে হাসি ফোটাতে সক্ষম হয়েছি আমরা। তিনি জানান ঈদের আগে এবং পরে এমন অনেক রাত গেছে যেই রাত গুলো আমার পিকআপে জার্নি করতেই পার হয়ে গেছে। পরিবার তাকে সাপোর্ট করে বলেই আজকে তিনি এই জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছেন। তিনি বলেন তার পরিবার যদি এসব কাজে তাকে বাঁধা দিতো তাহলে এসব মানুষের দোড় গোড়ায় এসে পৌঁছাতে পারতেন না। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় দেখা যায় পারিবারিক কিছু অনুষ্ঠান মিস করে ফেলেন কিন্তু তিনি বলেন এতে তার কিংবা তার বাবা মায়ের মাঝে বিন্দু মাত্র আক্ষেপ নেই, কেননা তিনি মানুষের জন্য কিছু করে এসে দিন শেষে তাদের মুখের যেই হাসিটা এই হাসিটাই তার সব ক্লান্তি সব আক্ষেপ দূর করে দেয়। আর দিন শেষে জিসান এটা নিয়েই অনেক খুশি থাকেন। তার স্বেচ্ছাসেবী কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২০ সালে তাকে শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপ্রেরণা:
জিসানের গল্প তরুণদের জন্য একটি প্রেরণার উৎস। তিনি দেখিয়েছেন যে সঠিক উদ্যোগ এবং অধ্যবসায়ের মাধ্যমে একটি স্বপ্ন কিভাবে সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে। তার বার্তা তরুণদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট: "নিজের স্বপ্নে বিশ্বাস রাখুন, কাজ শুরু করুন, এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে যেকোনো কিছু সম্ভব। আমরা একসাথে স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখতে পারি এবং তা বাস্তবে রূপ দিতে পারি। তার সাহসিকতা এবং অবিচলতা তরুণদের মনে নতুন উদ্যম সৃষ্টি করবে। জিসানের এই পথচলা তরুণদের শেখাবে যে স্বপ্ন পূরণের জন্য বড় কিছু করতে হবে না, ছোট কাজের মাধ্যমেও বড় পরিবর্তন আনা যায়। তার মতো তরুণরা সমাজে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরও অনেক তরুণকে স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করবে। তরুণদের জন্য জিসান বলেন "পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখুন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে কাজ শুরু করুন। আপনি নিজেই হতে পারেন আপনার নিজের গল্পের নায়ক, এবং আপনার কাজের মাধ্যমে সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন।"
জিসানের এই উদ্যোগগুলো শুধু অসহায় মানুষদের জীবন মান উন্নত করতে সহায়তা করেনি, বরং অনেক তরুণকে স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন যে তরুণরাই পারে সমাজে পরিবর্তন আনতে। তার সাহসিকতা এবং নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে "চলো স্বপ্ন ছুঁই" অনেক মানুষের জীবনে আশার আলো জ্বালিয়েছে।