মিরসরাই (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি: মিরসরাইয়ের পাহাড়ি এলাকায় খৈয়াছড়া, রূপসী, নাপিত্তাছড়া, সোনাইছড়ি, বোয়ালিয়া ও মহামায়া বুনো ঝর্না দেখতে আসেন দূরদূরান্তের পর্যটকরা। পাহাড়ের শরীর লেপ্টে টলমলে স্বচ্ছ পানির ধারা গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখতে গিয়ে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়রা। অসতর্কতা ও সাঁতার না জানার কারণে ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। এর অব্যবস্থাপনা দেখে অসন্তোষ প্রকাশ করলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রকৃতিপ্রেমিরা জীবনের ঝুঁকি নেন। নানা প্রতিকূলতা ও অব্যবস্থাপনায় গত ৫ বছরে এসব ঝর্নায় ১২ পর্যটক প্রাণ হারান, আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। এছাড়া গাইড ছাড়া বিভিন্ন ঝর্নায় যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে গভীর জঙ্গলে চলে যাওয়া শতাধিক পর্যটককে উদ্ধার করেছে জোরারগঞ্জ ও মিরসরাই থানা পুলিশসহ ফায়ার সার্ভিস টিম। তবুও টনক নড়েনি ইজারাদার ও বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্টদের। ইজারাদারের দাবি, ঝর্নায় আসা পর্যটকদের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হলেও তারা মানছেন না, ফলে দুর্ঘটনা বাড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরসরাইয়ে বিভিন্ন পাহাড়ে অবস্থিত ৫টি প্রাকৃতিক ঝর্না ইজারা দেয় চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ। বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের অধীনে ঝর্নাগুলো দেখাশোনা করা হয়। প্রত্যেক বছর ইজারামূল্য বাড়লেও পর্যটকদের জন্য এখনো নিরাপদ হয়ে উঠেনি ঝর্নাগুলো। প্রত্যেক বছর এসব ঝর্না দেখতে এসে নিহত হচ্ছেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া গত ৩ বছরে ঝর্নাগুলোর ইজারামূল্য বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ২০২২ সালে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের অধীনে ঝর্নাগুলোর ইজারা দেয় বন বিভাগ। ওই বছর ১২ লাখ টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে ২৯ লাখ টাকায় ইজারা নেন এএইচ এন্টারপ্রাইজ। চলতি বছর ৩০ লাখ টাকায় ইজারা নেন সোমোশন এন্টারপ্রাইজ।
স্থানীয়দের দাবী, ঝর্না দেখতে আসা সিংহভাগ পর্যটক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পড়ুয়া। এদের মধ্যে অনেকে সাঁতার জানেন না। তাই ঝর্নার নিচে থাকা কূপে পড়ে গেলে উঠতে না পারায় প্রাণ হারাচ্ছেন। গত ২৭ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝর্নায় ৬ জন ঘুরতে এসে পাথর পড়ে মাহবুব হাসান (৩০) নামের ওয়ান ব্যাংক কর্মকর্তা নিহত হন ও গাজী আহমেদ বিন শামস (৩৫) নামে আরেকজন গুরুতর আহত হন। তারা সহকর্মী ছিলেন।
মিরসরাই ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে, ২০২০ সালের খৈয়াছড়া ঝর্না ও নাপিত্তাছড়া ঝর্নায় ২ জন নিহত ও ৪ জন আহত হন। ২০২১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর খৈয়াছড়া ঝর্নার উপর থেকে পড়ে আহত হন একজন। ২০২২ সালে ২ জন নিহত ও ৩ জন আহত হন। ২০২৩ সালে ২ জন নিহত ও একজন আহত হন। একই বছরের ২৭ জুন সোনাইছড়ি ঝর্না দেখতে এসে পথভ্রষ্ট হন ১৫ পর্যটক। এ সময় জরুরি সেবায় যোগাযোগ করে সাহায্য চান তারা। পরে মিরসরাই থানা পুলিশ ও ফায়ার সাভির্সের কর্মীরা দুর্গম পাহাড় থেকে তাদের উদ্ধার করেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ জন নিহত ও ৩ জন আহত হন। নিহতদের একজন ঢাকার শহিদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আল শাহরিয়া (২১)। অন্য তিনজনের মধ্যে দুজন কুমিল্লা সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র অঞ্জন বড়ুয়া ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ফয়সাল হক। অন্যজন ইউনির্ভাসিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের চারুকলা প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সিফাতুর রহমান। ৫ বছরে সবচেয়ে বেশি পর্যটক নিহত হয়েছেন খৈয়াছড়া ঝর্নায়। ওই ঝর্নায় ৫ বছরে নিহত হয়েছেন ৭ জন।
চলতি বছর ভ্যাট-ট্যাক্স ছাড়া ৩০ লাখ টাকায় ঝর্নাগুলোর ইজারা নেয় সোমোশন এন্টারপ্রাইজ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিনিধি বলেন, ‘ঝর্নায় আসা সিংহভাগ পর্যটক এলাকাটি সম্পর্কে অবগত নন। তাই প্রত্যেক পর্যটককে আমরা গাইড নিতে বললে তারা নেন না। আমাদের পক্ষ থেকে ঝূঁকিপূর্ণ স্থানে যেতে তাদের বারণ করা হয়।’
নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে ঝর্নার দায়িত্বে থাকা বারৈয়াঢালা রেঞ্জ কর্মকর্তা আশরাফুল আলম বলেন, ‘পর্যটকদের টিকিট দেওয়ার সময় বিপজ্জনক স্থানগুলোতে না যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এছাড়া বন বিভাগ থেকে ঝূঁকিপূর্ণ স্থানে না যেতে ঝর্না পথে ফেস্টুন দেওয়া হয়েছে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. কামাল হোসেন মিরসরাইয়ের ঝর্নাগুলোতে প্রাণহানীর বিষয়ে বলেন, ‘সিংহভাগ পর্যটক আসেন সমতল থেকে। তাদের পাহাড় ও ঝর্নার নিচের কূপের গভীরতা সম্পর্কে ধারণা থাকে না। তাই না জেনে পর্যটকরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছেন। ঝর্নায় আসা সবাইকে আগে থেকে ধারণা নেওয়া উচিত।’