কোপা আমেরিকার ফাইনাল। ঘড়ির কাটা ১১২ মিনিটের ঘরে যাই যাই করছে। ক্যামেরা ঘুরে গেল মেসির দিকে। ফুলে যাওয়া গোড়ালি নিয়ে ডাগআউট ধরে দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। হঠাৎ গলা উচিয়ে কিছু একটা দেখলেন, ভালোভাবে দেখতে আরেকটু সরু হয়ে উঁকি দিলেন, পরক্ষণেই দুই হাত উচিয়ে গর্জে উঠলেন। গোল করেছেন লাওতারো মার্টিনেজ! আর্জেন্টিনার ষোড়শ শিরোপা জয়ী গোল।
কোপা আমেরিকার ২০২৪ সালের আসরে দলকে একাই টেনেছেন লাওতারো। প্রথম ম্যাচ কানাডার বিপক্ষে গোলের খাতা খুলে শুরু। পরের ম্যাচে, পরের ম্যাচে চিলির বিপক্ষে আরও একটি। পেরুর বিপক্ষে জোড়া গোলে শাপমোচনের প্রায়শ্চিত্ত করেন ইন্টার মিলান তারকা। আর ফাইনালে তো নায়ক হয়ে এলেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার বিদায়ী উপাখ্যানে।
কিন্তু শাপমোচন কেন? দুর্দান্ত ফর্ম নিয়ে পা রেখেছিলেন কাতার বিশ্বকাপে। লিওনেল মেসির সঙ্গে প্রথম একাদশে নিয়মিত খেলানোর পরিকল্পনা নিয়েই লিওনেল স্কালোনি তাকে নিয়েছিলেন বিশ্ব জয়ের মিশনে। কিন্তু প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের বিপক্ষে পুরোপুরি হতাশ করেন লাওতারো। ৩৬ বছরের খরা কাটানোর মিশনে মেসির স্বপ্নে ‘দুঃস্বপ্ন’ হয়ে এসেছিলেন।
৬ ম্যাচে মোট ২৪২ মিনিট মাঠে ছিলেন। কোনো গোল করতে পারেননি, সহায়তাও ছিলো না। প্রথম ম্যাচের পর লিওনেল স্কালোনি তাকে আর কোনো ম্যাচে নব্বই মিনিটই খেলাননি। লাওতারোর বদলে সুযোগ পেয়ে আর্জেন্টিনার আকাশে উদয় হন জুলিয়ান আলভারেজ। আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে ফিরলেও লাওতারোকে ফিরতে হয় শূন্য হাতে।
বিশ্বকাপে ব্যর্থতার জের ধরে আর্জেন্টিনার জার্সিতে লাওতারোকে আর দেখা যাবে কিনা এ নিয়ে সংশয়ে ছিলেন অনেকেই। কিন্তু একজন এই দুঃসময়েও পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা দিচ্ছিলেন তাকে। স্কালোনি যেন জানান দিলেন, ‘ফিনিক্স পাখির মতো ফিরে আসো ম্যান।’ কোচের ভরসার প্রতিদান দিতে কোপা আমেরিকার আসরকেই বেছে নিলেন ‘এল তারো’। শাপমোচনের গল্পে লিখলেন ‘শূন্য থেকে শিখরে’র মহাকাব্য।
আগেই জানা গিয়েছিল, এই আসর দিয়েই আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরে যাবেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। সেই সঙ্গে মেসিও খেলতে নামবেন নিজের শেষ আসর। দুই মহাতারকার বিদায় রাঙাতে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে নক্ষত্র হয়ে উঠতে চাইলেন লাওতারো। দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার।
ম্যাচ শেষের বাঁশি বাজতেই চোখের জলে ভাসলেন ডি মারিয়া। আরেকবার আনন্দাশ্রু বিসর্জন দিলেন মেসি। সতীর্থরা সব যোগ দিলেন একই দলে। কেবল লাওতারো ছিলেন নির্বাক। তার চোখ বেয়ে জল নামেনি। জয়ের আনন্দে মুখে হাসিও ফোটেনি। কেবল জানিয়ে দিলেন্, শাপমোচনের গল্পে তিনি এক দহিত রাজপুত্র। যাকে জিততে হবে আরও, নিজের জন্য, সতীর্থদের জন্য।
পুরো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার মোট গোল ৯টি, এর মধ্যে এক লাওতারোই করলেন পাঁচটি। তাতে বাগিয়ে নিয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার ‘গোল্ডেন বুট’। স্বর্ণের জুতোয় প্রত্যাবর্তনের গল্পে যার শাপমোচনের শুরু, সময় তাকে রাঙিয়ে দিক সোনালী আলোর ঝর্ণাধারায়।