বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ক্যাডার, নন-ক্যাডার পরীক্ষাসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। সম্প্রতি প্রশ্নফাঁস চক্রের ১৭ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পরীক্ষার্থীকে কীভাবে দেওয়া হয়, তা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরও খোলাসা করেন জবানবন্দি দেওয়া আসামিরা।
আদালত ও সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা ও আশপাশে বিভিন্ন নিরাপদ কক্ষ (চক্রের সদস্যদের ভাষায় বুথ) ভাড়া নিয়ে সেখানে চাকরিপ্রার্থীদের জড়ো করে প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করানো হতো বলে আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গ্রেপ্তার আবেদ আলীসহ ছয় আসামি।
সিআইডির কর্মকর্তারা জানান, ২০০৫ সাল থেকে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারের অন্তত ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিরা জড়িত।
মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আবেদ আলী বলেন, রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার আগে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ও এর উত্তর অফিস সহকারী সাজেদুলের কাছ থেকে নিয়েছিলেন তিনি। ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর পড়ানোর জন্য নিয়োগ পরীক্ষার দুই দিন আগে দুই দিনের জন্য ৪০ হাজার টাকায় তিনি সাভারের রেডিও কলোনিতে একটি বড় কক্ষ ভাড়া নিয়েছিলেন। এই কক্ষে ৫০ থেকে ৬০ জন চাকরিপ্রার্থীকে ফাঁস করা প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করিয়েছিলেন আবেদ আলী। এ জন্য একেকজনের কাছ থেকে তিনি ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা করে নিয়েছেন।
আবেদ আলী আদালতকে বলেন, ৬ থেকে ৭ মাস আগে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর নিয়োগ পরীক্ষার আগে মিরপুরের শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ার মাঝামাঝি স্থানে দুই দিনের জন্য একটি কক্ষ ভাড়া নেন তিনি। তখন ৪৪ জন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে তিনি চার লাখ টাকা করে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া ২০০৫ সালে তিনি গণপূর্তের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষায় চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে ফাঁস করা প্রশ্নপত্র বিক্রি করে তিন লাখ টাকা করে নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ জনের চাকরি হয়েছে।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সাজেদুল ইসলাম বলেন, রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন তিনি পিএসসির এক সদস্যের কক্ষে থাকা ট্রাংক থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। এই প্রশ্নপত্র তিনি পিএসসির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী ও পিএসসির ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমানের কাছে ৭৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তিনি পানির ফিল্টার ব্যবসায়ী। পল্টনের কালভার্ট রোডের একটি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় পানির ফিল্টারের গুদাম রয়েছে। তার ব্যবসায় সহযোগিতা করেন তারই ছোট ভাই সিদ্ধেশ্বরী কলেজের ছাত্র সায়েম হোসেন। পিএসসির অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম তার (সাখাওয়াত) বন্ধু। সাজেদুল প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করে চাকরিপ্রত্যাশী কেউ থাকলে জানাতে বলতেন তাকে। রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৪ জন প্রার্থীকে বৃহস্পতিবার তার ওই গুদামকক্ষে রাখা হয়। রাতভর ওই চাকরিপ্রার্থীরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র মুখস্থ করে পরের দিন পরীক্ষা দিতে যান।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে সায়েম হোসেন বলেন, পল্টনের কালভার্ট রোডের গুদামটি চাকরিপ্রার্থীদের পড়ানোর ‘বুথ’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তিনি এই বুথে চাকরিপ্রার্থীদের পড়াতে সহায়তা করতেন।
সিআইডি সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের সঙ্গে বিজি প্রেসের কারও যোগসাজশ আছে কি না, পিএসসির কতজন জড়িত, কে কত টাকা লেনদেন করেছেন, এভাবে কে কত টাকা আয় করেছেন, সেসব টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে কি না— সেসব বিষয়ে তদন্ত চলছে।
উল্লেখ্য, গত ৭ জুলাই রাতে বিসিএসের প্রশ্নফাঁস নিয়ে পিএসসির বিরুদ্ধে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এরপর ফেসবুকে পিএসসির গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর পোস্টগুলো ভাইরাল হতে থাকে।
৮ জুলাই রাতে রাজধানীর পল্টন থানায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন আইনে সিআইডির উপপরিদর্শক নিপ্পন চন্দ্র চন্দ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় ৩১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সেই মামলায় আবেদ আলীসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।