আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট নিয়ে ভয়ঙ্কর জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে অটোমোবাইল এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে গোপনে ভুয়া আন্তর্জাতিক পারমিট সরবরাহ করে প্রতারণা করছে। তাদের দেয়া এসব পারমিটের উপর আস্থা রেখে বিদেশে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন প্রবাসীরা।
শুধুমাত্র নাম, ছবি, ঠিকানা আর রক্তের গ্রুপ লিখে দিলেই টাকার বিনিময়ে মেলে ভুয়া পারমিট। একদল দালাল চক্রের যোগসাজশে এসব পারমিট সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া বৈধ পারমিটও দিচ্ছে নিজেদের মর্জিমতো ফি নির্ধারণ করে। এসব নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলি ফুয়াদ পাশা বাবুলের নেতৃত্বে। বিষয়টি অনুসন্ধান করতে একটি আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট করতে দেন এই প্রতিবেদক। পরে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে মাত্র ৪ দিনের মধ্যে অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের একটি আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট মিলে। তবে আসলের মতো দেখতে সেই ড্রাইভিং পারমিটটি ভুয়া।
আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট পেতে চালককে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি-বিআরটিএ কর্তৃক বৈধ ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হয়। সেই লাইসেন্সের উপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট দেয়া হয়। তবে এজন্য নতুন করে কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না। আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট নিতে আবেদনপত্র সংগ্রহ করে তা পূরণ করতে হয় এবং বিআরটিএ এর ড্রাইভিং লাইসেন্স এর সত্যায়িত ফটোকপি জমা দিতে হয়। এ ছাড়া প্রয়োজন হয় পাসপোর্টের ফটোকপিও।
নির্ধারিত ফি এর বিনিময়ে আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট দেয় অটোমোবাইল এসোসিয়েশন। তবে এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ভুয়া পারমিট দিচ্ছে তারা। এমনকি মানবজমিন প্রতিবেদককে দেয়া ভুয়া পারমিটের বিনিময়ে আবেদন, লোকাল লাইসেন্সের সত্যায়িত ফটোকপি কিংবা পাসপোর্টের ফটোকপিও জমা নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। ওই আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিটে ভুল নাম ও ভুল ঠিকানা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পারমিটে দেয়া বিআরটিএ এর এক কর্মকর্তার জাল স্বাক্ষরও ব্যবহার করেছে অটোমোবাইল এসোসিয়েশন। মিরপুর সার্কেলে কর্মরত বিআরটিএ এর ওই কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, আমার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে।
এটা নিয়ে আমি বিব্রত। এটা আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আগে ২৫০০ টাকা ফি নিয়ে আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট দিতো অটোমোবাইল এসোশিয়েশন। তবে বিআরটিএকে না জানিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো ফি বাড়িয়ে দিয়ে পারমিটগুলো ইস্যু করছে। খাতা কলমে ফি নির্ধারণ করেছে ৪৭০০ টাকা। তবে প্রতিটি পারমিটে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। কিন্তু গ্রাহককে ৪৭০০ টাকার রশিদই ইস্যু করা হচ্ছে। মোহাম্মদ হোসেন নামে এক ভুক্তভোগী মানবজমিনকে বলেন, আমি মালয়েশিয়ার জন্য তাদের কাছে পারমিট করতে দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাকে ভুয়া পারমিট দিয়েছে। মালয়েশিয়া পুলিশ এটা চেক করার পর ধরা খেয়েছি।
তখন আমাকে ১৫ হাজার টাকার মতো জরিমানা করেছিল। তিনি বলেন, আমার প্রবাসী আরেক বন্ধুও তাদের থেকে পারমিট নিয়ে পুলিশের হাতে ধরা খেয়েছিল। তারটাও ভুয়া ছিল। পরে ওই দেশে নতুন করে ট্রেনিং করে লাইসেন্স নিতে হয়েছে। নাঈম নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ওমানে আমার কাজের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে ড্রাইভিং করার জন্য অটোমোবাইল এসোসিয়েশন থেকে পারমিট করিয়েছিলাম। কিন্তু ওমানের এক সার্জেন্ট আমার থেকে পারমিট নিয়ে সফটওয়ারে মিলিয়ে দেখে এটার কোনো অস্তিত্ব নাই। পরে ওটা তারা নিয়ে নষ্ট করে ফেলে। আমি তো আগে বুঝিনি ওটা ফেক।
মঙ্গলবার অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের কার্যালয়ে গেলে সেখানে পারমিট নিতে অনেক মানুষের ভিড় দেখা যায়। জানালা দিয়ে গ্রাহকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাজগুলো সম্পন্ন করে প্রতিষ্ঠানটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রাহক বলেন, গত ১লা জুলাই তাদের কাছে আবেদন করি, ৯ই জুলাই আমাকে পারমিট দেয়া হয়। পারমিটের জন্য আমি ১০ হাজার ৭০০ টাকা দিয়েছি। কিন্তু তারা আমাকে ৪ হাজার ৭০০ টাকার রশিদ দিয়েছে। সূত্র জানায়, অটোমোবাইল এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ আলি ফুয়াদ পাশা বাবুল ও তার আত্মীয়রা প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করে। কয়েকজন দালাল চক্রের যোগসাজশও রয়েছে তাদের সঙ্গে। এসব দালাল চক্রের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ভুয়া ড্রাইভিং পারমিট দেয় তারা।
অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের কাছে আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিট ইস্যু করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো ধরনের অনুমোদন রয়েছে কিনা সেটি জানতে চেয়েছে বিআরটিএ। চার মাস আগে তাদের এই সংক্রান্ত একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানটি আন্তার্জাতিক ড্রাইভিং পারমিটের সুনির্দিষ্ট কোনো অনুমোদনের কপি দেখাতে পারেনি বলে বিআরটিএ সূত্র জানিয়েছে।
বিআরটিএ এর প্রধান কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, বিআরটিএ এর কোনো অনুমতি নেই তাদের। বিআরটিএ এর আগে পুলিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতো। কিন্তু তখন তারা পুলিশের কাছেও কোনো অনুমোদন নেয়নি। আমাদের লাইসেন্সের ভিত্তিতেই তারা আন্তর্জাতিক ড্রাইভিং পারমিটের অনুমোদন করে দেয়। তিনি জানান, ওই সংস্থাটির দেয়া নথিপত্রগুলো যাচাই-বাছাই করে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে সোমবার বিকাল ৩টায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে গেলে তারা পরদিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে দেখা করতে বলেন। তাদের কথামতো মঙ্গলবার দুপুর ১টা ৩০ মিনিটের দিকে ফের কার্যালয়ে গেলেও কোনো কথা বলতে রাজি হননি তারা। পরে একইদিন রাতে অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আলি ফুয়াদ পাশা বাবুল মুঠোফোনে মানবজমিনকে বলেন, আমরা কোনো ভুয়া পারমিট ইস্যু করি না। ইন্টারন্যাশনাল জাল লাইসেন্স করে এমন উত্তরায় আছে, বনানীতে আছে। বাংলাদেশের ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকলে ওটা আমরা আন্তর্জাতিক করে দেই।
আন্তর্জাতিক পারমিট দিতে বিআরটিএ এর কোনো অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আনুমোদন না থাকলে কি আমরা লাইসেন্স করি। কী অনুমোদন আছে জানতে চাইলে আলি ফুয়াদ পাশা বলেন, টেলিফোনে এসব বলা যাবে না। সম্প্রতি কিছুদিন প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফি বাড়ার কারণে বন্ধ ছিল। এখন আন্তর্জাতিক পারমিটের ফি ৪৭০০ টাকা। এ ছাড়া আর কোনো প্রশ্নের উত্তর দেননি তিনি।
এ বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান গৌতম চন্দ্র পাল মানবজমিনকে বলেন, আমি বিষয়গুলো যাচাই করে দেখবো। তারা যদি আইন বহির্ভূত কাজ করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।