চলতি মাসে বাংলাদেশে যে সংকট দেখা দিয়েছে তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনামলে নজিরবিহীন ঘটনা। সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভে নামার জেরে এর সূত্রপাত হয়। তারা পুলিশ এবং ক্ষমতাসিন দলের ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং রাজধানী ঢাকার রাস্তার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। তারা রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারকারী বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন) -তেও হামলা করে, যখন সহিংসতা দেশের ৬৪টি জেলায় প্রায় অর্ধেক জায়গাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। জবাবে সরকার সশস্ত্র সৈন্য পাঠায় এবং ২০ জুলাই থেকে দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশের পাশাপাশি দেশব্যাপী কারফিউ জারি করে।
২৩শে জুলাই আংশিক পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত ইন্টারনেট পরিষেবাগুলোও বন্ধ করে দেয় সরকার । বিশ্ব থেকে দেশের ১৭১ মিলিয়ন মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ততক্ষণে সরকারের কঠোর পদক্ষেপগুলো ঢাকার বিক্ষোভকে অনেকটাই শান্ত করে এনেছে। প্রতিদিন দুই ঘণ্টার জন্য সাধারণ মানুষকে বাইরে বেরোনোর ছাড়পত্র দেয়া হয়েছিল প্রয়োজনীয় কাজ সারার জন্য। তবুও গত কয়েকদিনে প্রায় ২০০ জন বিক্ষোভকারী এবং তাদের সমর্থনকারী নিহত হয়েছে (সম্ভবত আরও বেশি) এবং হাজার হাজার আহত হয়েছে, হিসাবটা হয়তো এমন যা সামনে আনার মানসিকতা শেখ হাসিনার নেই।
১৫ বছরের নিরবচ্ছিন্ন শাসনের মধ্যে এটি তার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। সাম্প্রতিক দিনের সহিংসতার জন্য কর্তৃপক্ষ কমপক্ষে ৬১,০০০ জনকে অভিযুক্ত করেছে, যার মধ্যে অনেকেই বিরোধী দলের। যাদের শেখ হাসিনা সর্বদা দেশে যা কিছু ঘটে তার জন্য দায়ী করে এসেছেন। এমনকি আন্দোলনের উপর এই ক্র্যাকডাউন অর্থনীতিকে হুমকির মুখে ফেললেও, প্রধানমন্ত্রী বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত ‘অপরাধীদের’ বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিশোধের আহ্বান জানিয়েছেন। সঙ্কটের মধ্যে তার প্রতিহিংসাপরায়ণ এবং আপসহীন প্রতিক্রিয়া জনগণের মধ্যে ভুল ধারণার জন্ম দেয়।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগটি প্রথম সামনে আসে জুন মাসে, যখন হাইকোর্ট ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সরকারি চাকরির ৩০% আলাদা করে রেখে দীর্ঘদিনের কোটা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে সরকারকে নির্দেশ দেয়।
একবার বিবেচনা করুন যে, ক্ষমতাসিন দল আওয়ামী লীগের (আ.লীগ) শিকড় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে প্রোথিত এবং শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ( যিনি আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৫ সালে তাকে হত্যার আগ পর্যন্ত নতুন দেশের নেতা ছিলেন) কন্যা হওয়ার জন্য অনেক কিছুই করেছেন।
এর অর্থ হলো কোটা আওয়ামী লীগের সদস্যদের সুবিধার জন্য তৈরি করা হয়েছিল । যেখানে দুই-পঞ্চমাংশ তরুণ বাংলাদেশিদের নিয়মিত কর্মসংস্থান নেই, সেখানে এই কোটা ব্যবস্থা তাদের স্নায়ুতে আঘাত করে। প্রায় ৪ লাখ স্নাতকদের ইতিমধ্যেই একটি অনিশ্চিত কর্মসংস্থানের বাজারে মাত্র ৩০০০ সরকারি চাকরির জন্য প্রতি বছর প্রতিযোগিতা করতে হয়। অন্ততপক্ষে সরকার একটা ভালো কাজ করেছিল যে, তাড়াহুড়ো করে দেশের শীর্ষ আদালতকে নিম্ন আদালতের রায়কে বাতিল করতে বলা। ২১শে জুলাই সুপ্রিম কোর্ট কোটা কমিয়ে ৫% করেছে। তবে কোটা পদ্ধতির চেয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ অনেক বেশি। একজন শিক্ষিত তরুণ বাংলাদেশির জন্য প্রায় প্রতিটি চাকরির সুযোগ, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে পুলিশ সদস্য থেকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি পর্যন্ত, আওয়ামী লীগের মাধ্যমে চলে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং রাজপথে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ একটি পেটোয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করছে। কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে স্নাতকদের কক্ষ বিতরণও তারাই নিয়ন্ত্রণ করে। অনেকেই এই সংগঠনকে ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু সেটি কখনো হবার নয়।
শেখ হাসিনার শাসনের স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনা নেই। বিগত ১৫বছরে তিনি বড় ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছেন, কিন্তু একইসঙ্গে নির্বাচনে কারচুপি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুণ্ন করা এবং আওয়ামী লীগ ও এর ব্যবসায়িক বন্ধুদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতির সভাপতিত্ব করার অভিযোগের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি । এখন যারা তার শাসনের সমালোচনা করে তাদের প্রতি হাসিনার প্রতিক্রিয়া হলো, তাদের ‘রাজাকার’ হিসেবে অভিযুক্ত করা -১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সহযোগী। এটাই বোঝায় যে, ৭৬ বছর বয়সী প্রধানমন্ত্রী বাস্তবতা থেকে কতটা দূরে রয়েছেন। এমনকি মিত্ররাও গোপনে স্বীকার করেছেন যে, তিনি ভুল করছেন। তারপরও কোনো মন্ত্রী তার মুখের ওপর কথা বলার সাহস পান না। এর অর্থ হলো ক্ষমতাসিন দলের অবক্ষয় টিয়ার গ্যাসের দুর্গন্ধের মতো তীব্র হচ্ছে। আ.লীগ আপাতত টিকে থাকবে, এমনকি সরকার-সংশ্লিষ্ট সহিংসতার রিপোর্ট বাড়ার পরেও। দলের একজন অভ্যন্তরীণ ব্যক্তি বলেছেন, আ.লীগ ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ দেশের সেবা করা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। আর তাই আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার জন্য সংকটের দীর্ঘমেয়াদী পরিণতি বিপর্যয়কর প্রমাণিত হতে পারে।