সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘাতের ঘটনায় সারা দেশে পুলিশের চিরুনি অভিযানে গতকাল রবিবার পর্যন্ত সাত হাজারের বেশি সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল ছিল অভিযানের নবম দিন। পুলিশের ওপর হামলা, স্থাপনা ভাঙচুর, সরকারি কাজে বাধা দেওয়াসহ সহিংসতার অভিযোগে বিভিন্ন জেলায় করা পাঁচ শতাধিক মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরো দুই সমন্বয়ককে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দিতে গতকাল হেফাজতে নিয়েছে ডিবি। তাঁরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী নুসরাত তাবাসসুম ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল। এ ছাড়া বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফ মাহতাবকে এই আন্দোলনে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে আটক করার দাবি করেছে পরিবার। তবে এখন পর্যন্ত কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছয়জনকে হেফাজতে নেওয়ার তথ্য দিয়েছে ডিবি।
এর আগে গতকাল ভোরে রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে নুসরাত তাবাসসুমকে আটক করে ডিবিতে নেওয়া হয়। অন্যদিকে গত শনিবার দিবাগত রাত ১টার দিকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক আসিফকে তাঁর রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে আটক করে ডিবিতে নেওয়ার দাবি করেছে তার পরিবার।
পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্র বলেছে, কোটা সংস্কারের দাবিতে গত ১ জুলাই শিক্ষার্থীদের লাগাতার আন্দোলন শুরু হয়। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সারা দেশে।
এ পরদিন থেকে এ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, সহিংসতা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগ বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মী।
গ্রেপ্তারকৃতদের বেশির ভাগ ব্যক্তিকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে পাঠানো হয়েছে। অনেককে রিমান্ডে এনে চলছে জিজ্ঞাসাবাদ। এসব ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে দল দুটির আরো অনেক নেতাকর্মী আছেন।
তাঁদেরও গ্রেপ্তারে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান চলছে।
এই নাশকতার ঘটনায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ২২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২২৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
ডিএমপি সূত্র জানায়, কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত করা মামলার সংখ্যা ২২৯টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন দুই হাজার ৭৬৪ জন।
গতকাল ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কে এন রায় নিয়তি এ তথ্য দেন।
তিনি বলেন, সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় গোয়েন্দা তথ্য ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সর্বশেষ গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ প্রক্রিয়াধীন।
র্যাবের অভিযানে আরো ৩০৪ জন গ্রেপ্তার
পুলিশের পাশাপাশি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) নাশকতার অভিযোগে গতকাল সকাল পর্যন্ত ৩০৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার সিনিয়র পরিচালক আ ন ম ইমরান খান এ তথ্য দেন। তিনি বলেন, সম্প্রতি নাশকতার অভিযোগে ঢাকায় ৭৭ জন এবং ঢাকার বাইরে ২২৭ জনসহ সারা দেশে ৩০৪ জনকে গ্রেপ্তার হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরসহ আটজনের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এ আদেশ দেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে মিরপুরের কাজীপাড়ায় মেট্রো রেল স্টেশনে হামলা, ভাঙচুরের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে রাজধানীর কাফরুল থানায় মামলা হয়েছে।
রিমান্ডে নেওয়া অন্য আসামিরা হলেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও যুবদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী সায়েদুল আলম বাবুল, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক ও বিএনপি নেতা মাহমুদুস সালেহীন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিরাপত্তার জন্যই তাঁদের ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, ‘নিরাপত্তা ঝুঁকিমুক্ত হওয়ার পরই তাঁদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করা হবে।’
গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী এসব কথা বলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন, সেটি তাঁরা জানিয়েছিলেন। এ কারণে তাঁদের নিরাপত্তার জন্যই হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
কারা উসকানি দিয়েছিল, জানতে চেয়েছি : ডিবিপ্রধান
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাতজন সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে। তবে ডিবি এ পর্যন্ত ছয়জনতে হেফাজতে নেওয়ার কথা স্বীকার করেছে। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ তাঁদের পরিবারকে উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে গতকাল রাজধানীর মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘কেউ যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তারা যদি বিভিন্ন জায়গায় বলে তাদের সঙ্গে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে, এটা জানার পর আমাদের নৈতিক দায়িত্ব তাদের নিরাপদে নিয়ে আসা। প্রশ্ন আসতে পারে, শুধু তাদের ক্ষেত্রে কেন নিরাপত্তার বিষয়। মনে রাখতে হবে, এই লোকগুলোকে কেন্দ্র করে, অর্থাৎ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘিরেই কিন্তু একটি অসাধুচক্র জামায়াত-বিএনপি এই সুযোগে অনুপ্রবেশ করে একটি গণতান্ত্রিক সরকারকে পতন ঘটাতে চেয়েছিল। এই চক্র রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী আগুন লাগাতে চেয়েছিল। সেই কারণে আমি মনে করি, এই চক্র যদি আবার শিক্ষার্থীদের কোনো কিছু করে আন্দোলনের কিছু করতে চায়, সে জন্য নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে নিয়েছি।’
কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে কত দিন রাখা হবে জানতে চাইলে ডিবিপ্রধান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা সমন্বয়কদের সঙ্গে কথা বলব এবং তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলব।’
নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি সমন্বয়কদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে ডিবিপ্রধান বলেন, ‘যেহেতু তারা নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের কাছে, এর পরও তাদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। আমরা তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সুন্দর একটা আন্দোলন ছিল, এই আন্দোলনের সময় তাদের সঙ্গে কারা কারা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে। কারা কারা তাদের উসকানি দিয়েছিল। আমরা তাদের কাছে এসব বিষয়ে জানতে চেয়েছি। তারা কিছু নাম এবং নম্বর আমাদের দিয়েছে।’
ডিবি কার্যালয়ে মারজুক রাসেল
গীতিকার ও অভিনেতা মারজুক রাসেল নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে কয়েক দিন ধরে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে একের পর এক প্রচার চালিয়ে স্ট্যাটাস দেওয়া হয়েছে। পেজটি থেকে সরকারের নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা করা হয় এবং সরকারবিরোধী নানা পোস্টও দেওয়া হয়েছে এবং সেই পোস্টগুলো দ্রুত ভাইরালও হয়েছে।
সাধারণ মানুষের ধারণা, মারজুক রাসেলই এমনটি করছেন। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া সেই পেজটি মারজুক রাসেলের নয়। কেউ তাঁর নাম ও ছবি ব্যবহার করে এমনটি করছে বলে জানিয়েছেন মারজুক রাসেল। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ জানাতে গতকাল রাজধানীর ডিবি কার্যালয়ে আসেন মারজুক রাসেল।
এ সময় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অভিনেতা বলেন, ‘আমার নাম ও ছবি ব্যবহার করে বেশ কয়েক দিন ধরে উসকানিমূলক পোস্ট দেওয়া হচ্ছে। যার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক ও সম্পৃক্ততা নেই। বিষয়টি নিয়ে আমি বিব্রত হচ্ছি।’
জাবির এক সমন্বয়ক আটক!
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেলকে ডিবি পরিচয়ে আটক করা হয়েছে বলে পরিবার সূত্রে জানা গেছে। গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে ভাড়া বাসা থেকে তাঁকে আটক করা হয় বলে জানান আরিফের ছোট বোন উম্মে খায়ের। আরিফ সোহেল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের (৪৭তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী। তিনি পরিবারের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী আমবাগান এলাকায় ভাড়া থাকতেন।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে ডিবি হেফাজতে নেওয়ার বিষয়ে তাঁর মা মমতাজ নাহার বলেন, ডিবি বলছে, নিরাপত্তার কারণে তাদের কাছে রেখেছে। গতকাল মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ের পাশে দাঁড়িয়ে মমতাজ নাহার সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।