ঢাকা
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ৭:৩২
logo
প্রকাশিত : জুলাই ৩১, ২০২৪

‘আমার বউ-ছেলেকে দেখে রাখিস ভাই’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চর জগন্নাথপুর গ্রামের দুই বন্ধু অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি বহুতল ভবনে বিক্ষোভকারীদের দেওয়া আগুনে তাদের মৃত্যু হয়। গত সোমবার (২২ জুলাই) তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

রমঙ্গলবার (২৩ জুলাই) সালাম ও সেলিমের মরদেহ গ্রামে পৌঁছালে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। শোক আর কান্নায় এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। সন্ধ্যায় স্থানীয় মসজিদ মাঠে তাদের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে স্থানীয় কবরস্থানে পাশাপাশি কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হন সালাম ও সেলিম।

এর আগে শনিবার (২০ জুলাই) বিকেলে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের চিটাগাং রোডের ‘প্রিয়ম নিবাস’ নামে একটি ভবনে আগুন দেন বিক্ষোভকারীরা। সেদিন সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা চেষ্টা করেও সেই আগুন নেভাতে ব্যর্থ হন। পরদিন আগুন নেভানো হলেও অশান্ত পরিস্থিতির কারণে উদ্ধার কাজ করা হয়নি। সোমবার দুপুরে ভবনটির দ্বিতীয় তলায় ডাচ বাংলা ব্যাংকের শাখা থেকে তাদের অগ্নিদগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

নিহত সেলিম মন্ডল (২৯) কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চর জগন্নাথপুর গ্রামের ওহাব মন্ডলের ছেলে। তার তিন বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। আর আব্দুস সালাম (২৪) একই গ্রামের মৃত সাবের বিশ্বাসের ছেলে। সালামের ১৫ মাস বয়সী একটা ছেলে সন্তান রয়েছে। সেলিম ও সালাম দুই বন্ধু এবং সহকর্মী। তারা একসঙ্গে কাজ করতেন।

নিহত সেলিমের ভাতিজা ফয়সাল মন্ডল বলেন, ‘ডাচ বাংলা ব্যাংকে ইন্টোরিয়রের কাজ করতে এক সপ্তাহ আগে সেখানে গিয়েছিলাম আমরা। তার আগে আমরা নরসিংদী কাজ করেছি। আমরা একসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে বেড়াতাম। শানিবার দুপুর আড়াইটার দিকে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা ব্যাংকের মধ্যে বসে ছিলাম। সাড়ে ৩টার দিকে আমাদের ওই ভবনে আন্দোলনকারীরা আগুন দেয়। ওই ভবনের ৫ তলায় পুলিশের ক্যাম্প ছিল। ছাদ থেকে পুলিশ গুলি করে।

এতে আন্দোলনকারীদের একজন মারা যান। পরে তারা প্রাইভেটকারের টায়ার এনে পেট্রল ঢেলে ব্যাংকের সিঁড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ইট ও খোয়া মারতে শুরু করে ভবনের জানালায়। এ সময় আমরা বাঁচার জন্য চিৎকার শুরু করি এবং দৌড়াদৌড়ি করি। পুরো রুম ধোঁয়ায় ভরে যায়, ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। এ সময় আমি আর আমার এক মামা আগুনের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি এবং বালুর ওপরে গড়াগড়ি করতে থাকি। খুব গোলাগুলি হচ্ছিল। একটা বস্তির লোকজন আমাদের উদ্ধার করে। এতে আমার পা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গা পুড়ে যায়। নিহত সেলিম আমার চাচা। সে ও তার বন্ধু সালাম তিন তলায় আটকে গিয়েছিল, তারা নামতে পারিনি। তারা দুজনেই মারা গেছে। সোমবার জানতে পারি, ব্যাংকের মধ্যে থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনে পুড়ে ও দম আটকে তারা মারা গেছে।’

নিহত সালামের ছোট ভাই আল-আমিন হোসেন বলেন, ‘শনিবার বিকেলে সালাম কল দিয়ে বলে, আমাদের এখানে পুলিশ ও আন্দোলকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হচ্ছে। আমাদের ভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে। কিছু দেখা যাচ্ছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি হয়তো বাঁচব না। আমি ইনকাম করে তোকে পড়াশোনা করাতে চেয়েছিলাম, খাওয়াতে চেয়েছিলাম। তা তো পারলাম না। তুই আমার বউ ও ছেলেকে দেখে রাখিস ভাই। এরপর আর কোনো কথা হয়নি। পরে বহুবার কল করলেও সে রিসিভ করেনি। ভাইয়ের উপার্জনে আমাদের সংসার চলতো। এখন আমরা অনেক বিপদে পড়ে গেলাম। সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।’

নিহত সালামের স্ত্রী মারিয়া খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামী কাজ করতে গিয়েছিল। সেখানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সাথে পুলিশের গোলাগুলি চলছিল। একপর্যায়ে ওই ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। এতে আমার স্বামী ভবনে আটকে পড়ে মারা যান। এখন বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে মহাবিপদে পড়ে গেছি। আমাদের দেখভাল করবে কে? আমাদের সংসার চলবে কীভাবে? সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই। সেই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাই।’

নিহত সেলিমের ভাই ওয়াজ মন্ডল বলেন, ‘সেদিন ভবনের নিচে প্রশাসনের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের গোলাগুলি শুরু হয়। পরে পুলিশ ভবনের ছাদের উপরে উঠে যায়। এ সময় আন্দোলনকারীরা ভবনের নিচে আগুন ধরিয়ে দেয়। অতিরিক্ত ধোঁয়ার কারণে রুম অন্ধকার হয়ে যায়। ভাই বের হতে না পেরে মারা গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাই ডাচ বাংলা ব্যাংকে কাঠের বোর্ডের আসবাবপত্র তৈরি করছিল ৬ জনকে নিয়ে। ভাই ছিল কন্ট্রাক্টর, বাকিরা ভাইয়ের সঙ্গে কাজ করতেন। সবাই বেরিয়ে গেলেও আমার ভাই সেলিম ও তার বন্ধু বের হতে পারেনি। দুজনেই মারা গেছে। দুই পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।’

নিহত সেলিমের বাবা ওহাব মন্ডল বলেন, ‘গ্রামের বাজারে আমার চায়ের দোকান আছে। আসরের পরে দোকানে গিয়েছি। তার আধাঘণ্টা পর আমার নাতি গিয়ে বলছে, দোকান বন্ধ করো, ছোট কাকা আগুনে পুড়ে মারা গেছে। এরপর ছেলেকে কল দিই। সে বলে, আব্বা আমি তো বাঁচব না। আমার জন্য দোয়া করো। এরপর আর কথা হয়নি। পরে জানতে পারি, আমার ছেলে মারা গেছে। আমরা গরিব মানুষ। ছেলের উপার্জনের অর্থে সংসার চলতো। এখান আমাদের সংসার কীভাবে চলবে? সেটা নিয়ে চিন্তিত। সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই। সেই সঙ্গে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

নিহত সেলিমের স্ত্রী শোভা খাতুন বলেন, ‘সেদিন দুপুরে খাওয়ার পর স্বামী কল দিয়েছিল। মেয়ের ও পরিবারের সবার খোঁজখবর নেয়। তার কিছুক্ষণ পর কল দিয়ে বলে, আমাদের বিল্ডিংয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা মনে হয় বাঁচব না। আমাদের জন্য দোয়া করো। পরে জানতে পারলাম সত্যিই স্বামী মারা গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্বামীর উপার্জনের অর্থে আমাদের সংসার চলতো। এখন আমাদের সংসার চলবে কীভাবে? আমার মেয়ে হুমাইরার বয়স মাত্র তিন বছর। এখন আমি এই মাছুম বাচ্চাকে কীভাবে মানুষ করবো? আমি সরকারের সহযোগিতা চাই। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের শাস্তি চাই।’

কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এসএম মিকাইল ইসলাম বলেন, ‘নিহতের পরিবারের সদস্যরা যদি আবেদন করেন, আর যদি সরকারি বরাদ্দ আসে তাহলে বিতরণ করা হবে।’

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram