ঢাকা
২২শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ৯:৩৫
logo
প্রকাশিত : আগস্ট ১৯, ২০২৪

বিদ্যুতে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জের নামে লুটপাট

আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থেকে বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হরিলুট চালিয়েছে। এ সময় বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইন বা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ করে আওয়ামী লীগ সমর্থক ব্যবসায়ীদের উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য অনুমোদন দেয়। আর এসব বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ

সক্ষমতায় ব্যবহার করা হবে- এমন শর্তে লাইন্সেস দেওয়া হলেও এসব কেন্দ্র গড়ে চলেছে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বছরের ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেই অলস বসে ছিল। প্রয়োজন না থাকলেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়ে উচ্চমূল্যের এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বছরের পর বছর ক্যাপাসিটি চার্জের নামে দেড় দশকে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ব্যক্তিদের পকেটে চলে যায়। এতে বিদ্যুৎ খাতের ব্যয় দিন দিন বেড়েছে। আর এই ব্যয়ের দায় চেপেছে জনগণের ঘাড়ে। এ কারণে দফায় দফায় বেড়েছে বিদ্যুতের দামও।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে অলস বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া মানে হচ্ছে সেখানে সরকারের অপচয় বা চুরি হচ্ছে। যদি কোনো কেন্দ্র বছরে খুব কম ব্যবহৃত হয় কিংবা যেসব কেন্দ্র একেবারেই ব্যবহৃত হয়নি সেগুলো স্ট্যান্ডবাই হিসেবে থাকে তাহলে এগুলো চালু রাখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত ১০ বছরে আইপিপি ও রেন্টাল কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় প্রায় সাড়ে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর পরের পাঁচ বছরে, ২০১৮-১৯ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় প্রায় ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিদ্যুৎ খাতের জন্য দেওয়া ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ব্যয় হয় ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ধরা হয় ৩৯ হাজার ৪০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। আর শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়া বাবদ ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার ৫৭৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে স্বাভাবিক সময়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট। আর তাপমাত্রা বাড়লে তা দাঁড়ায় সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ সর্বোচ্চ সক্ষমতার বিদ্যুৎ ব্যবহার ধরলেও প্রায় ১১ হাজার মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকে। আর এ কেন্দ্রগুলো বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়ে যাচ্ছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গত বছরে এক সমীক্ষায় দেখা যায়, বিদ্যুতে ভর্তুকির বেশির ভাগ অর্থই বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ মেটাতে ব্যয় হয়। এ ছাড়া পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনেও স্বীকার করা হয় যে, বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়ার প্রথা এক ধরনের ‘লুটেরা মডেল’ এবং তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চুক্তির ফল। ২০০৯ সাল আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরপত্রের মাধ্যমে আটটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল। সেই বছর আওয়ামী লীগ সরকার বিনা দরপত্রে ৩২টি কুইক রেন্টাল কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়। দরপত্র এড়াতে ২০১০ সালে জাতীয় সংসদে দুই বছরের জন্য পাস করা হয় জরুরি বিশেষ আইন। পরে আইনটির মেয়াদ কয়েক দফা বাড়িয়ে সর্বশেষ ২০২৬ সাল পর্যন্ত করা হয়। এই আইনের অধীনে ৭২টি রেন্টাল ও ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) কেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়। বিনা দরপত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বড় অংশই পেয়েছেন তৎকালীন সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে সামিট, ওরিয়ন, দেশ এনার্জি, ডরিন পাওয়ার, ইউনাইটেড, এনার্জিপ্যাক অন্যতম। সে সময় বিনা দরপত্রে বিদ্যুৎ কেন্দ্র পাওয়ার শীর্ষে ছিল সামিট গ্রুপ। সরকার ঘনিষ্ঠ এই এই গ্রুপ গোপালগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগের টানা ছয়বারের এমপি ও সাবেক বিমানমন্ত্রী ফারুক খানদের পারিবারিক ব্যবসা। সামিটের সাতটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া পেয়েছে ১ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউনাইটেড গ্রুপের ৫টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এগুলো পেয়েছে ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। কনফিডেন্স গ্রুপ বিনা দরপত্রে পেয়েছে ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার দিক থেকে গ্রুপটি তৃতীয় স্থানে রয়েছে। ৬টি কেন্দ্র বাবদ তারা পেয়েছে ৯৬২ কোটি টাকা। কেন্দ্র ভাড়া পাওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চম স্থানে আছে বাংলাক্যাটের ৪টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর ভাড়া ৮৮৩ কোটি টাকা। আর ষষ্ঠ সিঙ্গাপুরভিত্তিক সেম্বকর্প, ভাড়া ৭৮৫ কোটি টাকা। সপ্তম যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এপিআর এনার্জি, এর ভাড়া ৬৮০ কোটি টাকা। নবম ডরিন গ্রুপের ৬ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, যার ভাড়া ৬৫১ কোটি টাকা এবং দশম স্থানে দেশ এনার্জির চার বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া পায় ৫১৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ডরিন পাওয়ারের মালিক ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে ও ঝিনাইদহ থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী তাহজীব আলম সিদ্দিকী। দেশ এনার্জি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের প্রতিষ্ঠান।

বিদায়ী সরকারের দেওয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, পিক আওয়ারে সক্ষমতার অন্তত ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থাকে। কিন্তু এরপরও গত বছর ৫টি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এগুলোর সম্মিলিত ক্ষমতা ৬০০ মেগাওয়াটের কিছু বেশি। কেন্দ্রগুলো তিন বছরের মেয়াদে এসেছিল। এই সময়ের মধ্যে কেন্দ্রগুলোর মালিক লাভসহ বিনিয়োগ তুলে নেয়। এরপরও দফায় দফায় কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ মেয়াদ বাড়ানোর কারণে এসব কেন্দ্রের জন্য বছরে গুনতে হবে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। মেয়াদ বাড়ানো কেন্দ্রগুলোর মধ্যে আছে সামিটের নারায়ণগঞ্জে ১২০ মেগাওয়াট কেন্দ্র, কেরানীগঞ্জে পাওয়ারপ্যাকের ১০০ মেগাওয়াট, ডাচ-বাংলার মেঘনাঘাটের ১০০ মেগাওয়াট ও আইইএলের ১০০ মেগাওয়াট, জুলদার ১০০ মেগাওয়াট, আশুগঞ্জের ৫০ মেগাওয়াট ও ফেঞ্চুগঞ্জে ৫০ মেগাওয়াট।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, ক্যাপাসিটি চার্জের নামে যে অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় হয়েছে তা বাদ দিতে হবে। এজন্য যে পাওয়ার পার্সেস এগ্রিমেন্ট তৈরি করা হয়েছে তা বাতিল হতে হবে। এটি যেহেতু সরকার করেছিল তা বাতিল করা সরকারের জন্য ঝামেলাপূর্ণ হবে। এটি ক্যাবের সহযোগিতায় জনগণকে বাতিল করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার কাজটি করতে গিয়ে নিরপেক্ষ থাকবে। ভোক্তা স্বার্থ ক্ষতি হওয়ার কারণে জনগণই এই চুক্তি বাতিল করে নিয়ে আসবে। এজন্য যতটুকু ন্যায্য খরচ তার ভিত্তিতে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ হবে। এর ভিত্তিতেই ক্যাপাসিটি চার্জ বা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাড়ার দাম নির্ধারিত হবে। এই কয় বছরে বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ আসলে কত হয়েছে তা এক একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হিসাব আলাদা আলাদা করে নির্ধারণ করতে হবে। আর এই কাজটি বের করার জন্য নিরপেক্ষভাবে রেগুলেটরি কমিশনের ওপর দিতে হবে। তবে রেগুলেটরি কমিশনে যারা বসে আছে তারা এ পদের যোগ্য না। এ কারণে এই জায়গাটিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। দেশের যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা আছে তা দিয়ে বিগত সরকার যদি বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে তাহলে সেই পরিমাণ ক্ষমতার জন্য যে ক্যাপাসিটি চার্জ তা সেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে দেওয়া যাবে না। এটা ন্যায্য হতে পারে না। আর এই বিষয়টিও আইনি প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের স্টাবলিশ করতে হবে।

মূলত আওয়ামী লীগ সরকার বিনা টেন্ডারে দায়মুক্তি আইনের আওতায় এক সময়ে উচ্চ মূল্যের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমোদন দিয়েছিল। ২০১০ সালে বলা হয়েছিল এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র আপদকালীন চাহিদা মেটানোর জন্য। কিন্তু গত দেড় দশকেও এগুলো আর বন্ধ করা যায়নি। তিন মেয়াদে বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদন সক্ষমতা আওয়ামী লীগ সরকার বাড়িয়ে চলছিল। এতে বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো থেকে বিদ্যুৎ না কিনলেও নিয়মিত ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করে। এ সময় উৎপাদন না করেও অনেকগুলো কেন্দ্র অলস বসে থেকে পেয়েছে ভাড়া। আর এসব কেন্দ্রের বেশির ভাগেরই মালিক ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এই কেন্দ্রগুলোর ভাড়া পরিশোধ করতে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বেড়েছে। ২০০৮ সালে বিদ্যুৎ খাতে ৯০০ কোটি টাকা ভর্তুকি থাকলেও পরে তা কেন্দ্র ভাড়ার কারণে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর কারণ ভর্তুকির ৮০ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়েছে কেন্দ্র ভাড়ায়।

সর্বশেষ
logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram