সংসদ সদস্যরা (এমপি) নির্বাচনী ওয়াদা বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ পেতেন ২০ কোটি টাকা করে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ‘পল্লি অবকাঠামো উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ বরাদ্দ দেওয়া হতো। ২০২০ সালে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬ হাজার ৫২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। তৃতীয় এ প্রকল্পে ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা খরচের পর বরাদ্দ বাতিল করতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। এতে সরকারের সাশ্রয় হবে ২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা।
সারাদেশে এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতি বাড়ানোর জন্য এমপিরা এ টাকা বরাদ্দ পেতেন। ২০২০ সালের আগে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। সে সময় ৩০০ এমপি এ সুবিধা পেতেন। তৃতীয় প্রকল্প থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকার ২০ এমপিকে বাদ দিয়ে ২৮০ আসনের এমপির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। যেটার কাজ চলমান ছিল। যেহেতু এমপিরা এখন নেই সেহেতু টাকা নতুন করে কাউকে দেওয়া হবে না। আর নতুন করে আবার যে প্রকল্প নেওয়ার প্রস্তুতি চলছিল সেটাও বাতিল করেছে কমিশন।
চলমান প্রকল্পের অর্থব্যয় নিয়ে এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছে সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে জনগণের উদ্দেশ্য প্রাধান্য না দিয়ে অনেক এমপি নিজের উন্নয়নের পাশাপাশি স্বজনদের উন্নয়ন করেছে। যে কারণে এমপিদের তৃতীয় নম্বর প্রকল্পটি ৬৫ শতাংশ বাস্তবায়নের পরও বাতিল করা হচ্ছে বলে জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কারে সরকারের চাল ও গম বরাদ্দ দিয়েছিলেন রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী। কিন্তু প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা মিলেমিশে সেই বরাদ্দ লুটপাট করেন। সংস্কারমূলক কাজের জন্য কোথাও কোথাও এক ডালি মাটিও ফেলা হয়নি। অথচ টাকা ঠিকই তুলে নেন সাবেক এ এমপি।
রাজশাহীর সাবেক সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার বিরুদ্ধে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্প বরাদ্দে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ মিলেছে। অস্তিত্বহীন ও ভুঁইফোঁড় বিভিন্ন সংস্থাকে প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ঘুরেফিরে নামসর্বস্ব একই সংস্থাকে বরাদ্দ দেওয়া হয়। এছাড়া নিয়ম ভেঙে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতাকর্মীরাও বিশেষ বরাদ্দ পেয়েছেন।
ভুঁইফোঁড় ও অনিবন্ধিত সংস্থাগুলো বরাদ্দ পেতে এমপি বাদশার ব্যক্তিগত সহকারীকে (পিএ) উৎকোচ দিতে হয়েছে। সবশেষ তিন অর্থবছরের তালিকায় দেখা গেছে, ২০১৯-২০, ২০-২১ ও ২১-২২ অর্থবছরে ফজলে হোসেন বাদশা মোট ৪ কোটি ৭৬ লাখ ৫৭ হাজার ৪৯৯ টাকা ৯৭ পয়সায় ৭৮৭টি প্রকল্প দিয়েছেন। এর মধ্যে ১৮৩টি প্রকল্প ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। আর ১২৬টিই হলো নামসর্বস্ব নারী সংস্থা। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারাও বিশেষ সুবিধা নিয়েছেন।
এসব কারণ সামনে আসায় মূলত প্রকল্পটি বাতিল হচ্ছে বলে জানায় আইএমইডি। এ প্রকল্পসহ আরও বেশ কিছু প্রকল্প বাতিলের তালিকা প্রস্তুত করছে সংস্থাটি। দ্রুত সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা হবে।
এমপিদের ২০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার প্রকল্প প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘প্রকল্পটি বাতিল করা হচ্ছে। সারাদেশে এমপিই তো নেই সুতরাং প্রকল্প থাকবে কেন?’
প্রকল্পের অনেক অর্থ খরচ প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘খরচ হলেই যে প্রকল্প বাতিল করা যাবে না বিষয়টি এমন নয়। কারণ অর্ধেক অর্থ তো সাশ্রয় করতে পারবো।’
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) জানায়, প্রকল্পটি জুলাই ২০২০ সালে অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল ৬ হাজার ৫২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। সব অর্থই সরকারি কোষাগারের। চলতি বছরের জুলাই মাস নাগাদ খরচ হয়েছে ৪ হাজার ২৬৯ কোটি ১৮ লাখ টাকা। বাকি ২ হাজার ২৫৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে না। বাকি টাকা খরচের জন্য জুন ২০২৬ নাগাদ সময় পেতেন সাবেক এমপিরা। প্রকল্পের মোট অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ। এমপিদের জন্য নতুন প্রকল্প নেওয়ার কথা থাকলেও সেটা আটকে যাচ্ছে। এমপি পরিবর্তন হলেও প্রকল্প চলমান থাকায় ওই আসনে যিনি এমপি থাকতেন তিনিই বরাদ্দ পেতেন।
এলজিইডি জানায়, এই টাকা দিয়ে এমপিরা এলাকার রাস্তা, ব্রিজ, কালভার্ট, হাটবাজার ও বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন করতেন। তবে একবারে নয়, চার ভাগে প্রতিবছর পাঁচ কোটি টাকা করে বরাদ্দ পেতেন। এমপিরা নিজের লোকদের দিয়েই মূলত কাজগুলো বাস্তবায়ন করিয়ে ইচ্ছামতো টাকা তুলে নিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রত্যেক এমপি নিজ আসনের অবকাঠামো উন্নয়নে ১৫ কোটি টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছিলেন। এসময় ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এটি ২০১০ সালের মার্চ থেকে ২০১৬ সালের জুনে শেষ হয়। আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করলে নিজ নিজ আসনের জন্য এমপিরা আরও ২০ কোটি টাকা করে বরাদ্দ পান। এসময় ৬ হাজার ৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত কাজ হয়।
তবে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী মো. আলি আখতার হোসেন বলেন, ‘চলমান প্রকল্পটি হয়তো বাতিল করবে না। এটার কাজ সারাদেশে চলমান।’
এমপি নেই কাকে বরাদ্দ দেবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হয়তো নতুন প্রকল্পটি বাতিল করবে। চলমান প্রকল্পের টেন্ডার হয়ে গেছে।’
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় জানায়, প্রকল্পের টাকা যতই খরচ হোক সাশ্রয় করা বড় বিষয়। প্রকল্পের যদি আউটপুট না থাকে তবে কাজ শেষ ধাপে এলেও তা বাতিল করা হবে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি বলেন, কিছু খরচ হয়ে গেলেই প্রকল্প শেষ করতে হবে বিষয়টা এমন নয়। কিন্তু যৌক্তিক অর্থনৈতিক বিবেচনা হলো কত খরচ করেছি বিষয়টা এটা নয়, বাকি কাজ করতে কত লাগবে এটা বড় বিষয়। কিছু খরচ হয়ে গেছে বলেই মানসিক চাপ থাকবে প্রকল্প শেষ করতে হবে বিষয়টা এমন নয়। এটা অর্থনীতির যুক্তিতে চলে না।