আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি ও প্রতিমন্ত্রী হয়েই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন শাহরিয়ার আলম। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজের জমা দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, তিনি ছিলেন ভূমিহীন। অর্থাৎ তার কোনো স্থাবর সম্পদ ছিল না। কিন্তু ১৫ বছরেই তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার গোগ্রাম ইউনিয়নের বসন্তপুর মোড়ের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে নর্থ বেঙ্গল এগ্রো ফার্মস লিমিটেড নামের একটি কৃষি খামার। ৫২ বিঘা আয়তনের এই কৃষি খামারের মালিক সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম। এর মধ্যে ১২ বিঘা জমি খাস।
২০২০ সালে সেখানে একই প্লটে ৪০ বিঘা জমি কেনেন তিনি। জমির মালিক ছিলেন বাঘা উপজেলার বাঘা পেট্রোল পাম্পের মালিক গোলাম মোস্তফা। তার অভিযোগ, জমির মূল্য পরিশোধ না করে শাহরিয়ার আলম প্রতারণার মাধ্যমে দখল নিয়েছেন। একই সঙ্গে ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে দখল করেন ১২ বিঘা খাস জমি।
গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘‘ন্যাশনাল ব্যাংক গোদাগাড়ী শাখায় আমার ৬ কোটি টাকা ঋণ ছিল। ঋণ পরিশোধ করতে জমি বিক্রির উদ্যোগ নিই। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক ব্যক্তির সঙ্গে সাড়ে ১১ কোটি টাকা দাম চূড়ান্ত করে বায়নানামাও নেই। এ সময় শাহরিয়ার আলম জানতে পেরে তিনি জমিটা কিনবেন বলে আমাকে জানান। তিনি ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে ৬ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেন এবং আমাকে নগদ ৫০ লাখ টাকা দিয়ে জমিটা রেজিস্ট্রি করে নেন। কথা ছিল বাকি ৫ কোটি কয়েক দিনের মধ্যেই পরিশোধ করবেন। কিন্তু পরে তিনি আর টাকা দেননি। আমার সঙ্গে প্রতারণা করে শুধু ঘোরাতে থাকেন।’’
নর্থ বেঙ্গল এগ্রো ফার্মস লিমিটেড ছাড়াও শাহরিয়ার আলম খামারবাড়ি করেছেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার চৌধুরীহাট এলাকায়। এমপি হওয়ার পর ২০১০ সালে ২৫ বিঘা জমি কেনেন সেখানে। ২৫ বিঘা জমি কিনলেও প্রভাব খাটিয়ে আরও ১০ বিঘা খাস জমি দখল করেছেন তিনি। সেখানে গড়ে তুলেছেন বাংলো বাড়ি, গরুর খামার, টিস্যু কালচার ল্যাব, বনসাই গবেষণাগার।
এছাড়াও লালমনিরহাট জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায়ও ২০১৭ সালে ১৩ বিঘা জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে খামারবাড়ি। বিভিন্ন দামি সবজি, মাছসহ নানা ধরনের চাষাবাদ করা হচ্ছে সেখানে।
মূলত শাহরিয়ার আলমের ছোটবেলা কেটেছে লালমনিরহাট জেলায়। সেই সুবাদেই সেখানে জমি কিনে খামারবাড়ি গড়ে তুলেছেন। তার দীর্ঘদিনের এপিএস সিরাজুল ইসলাম সিরাজের বাড়িও এই কালীগঞ্জ উপজেলায়। শাহরিয়ার আলমের বাবা মো. শামসুদ্দিন ছিলেন পশ্চিমাঞ্চল রেলের কর্মচারী। সেই সুবাদে তাকে থাকতে হয়েছে লালমনিরহাটে।
শুধু কৃষি খামারই নয়, আওয়ামী লীগ সরকারের এমপি ও প্রতিমন্ত্রী হয়ে ১৫ বছরেই তিনি কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও গড়েছেন সম্পদ। রাশিয়া, ব্রাজিল ও চীনে খুলেছেন নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। গড়েছেন আটটি পোশাক কারখানা। নিয়েছেন নিজের রেনেসাঁ গ্রুপের নামে ‘দুরন্ত’ টেলিভিশন।
রাজশাহীতে গড়ে তোলেছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এছাড়াও ঢাকার গুলশানে নিজের নামে দুটি, পুত্রের নামে একটি এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর নামে নিয়েছেন ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের রাজকীয় ফ্ল্যাট।
চারঘাটের একমাত্র সিনেমা হল (লিলি সিনেমা হল) ছিল চারঘাট-বাঘা আঞ্চলিক মহাসড়কের মেরামতপুর এলাকায়। ২০১০ সালের পর সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলে হল মালিকরা ভবনসহ জমিটি বিক্রির উদ্যোগ নেন। ২০১৪ সালে শাহরিয়ার আলম প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর সিনেমা হলের জায়গাটি কিনে সেখানে গার্মেন্ট গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। মাত্র ৫০ লাখ টাকায় ৩৩ শতক জমি ও ভবনসহ সিনেমা হল কিনে নেন তিনি। কিন্তু ১০ বছর অতিবাহিত হলেও সেখানে গার্মেন্টের একটি পিলারও ওঠেনি।
২০২২ সালে চারঘাট সদরে উপজেলা ভূমি অফিসের পূর্ব পাশে বিশ্বনাথ রমেকা নামে এক ব্যক্তির কাছে থেকে ৩৩ শতাংশ জমি কেনেন শাহরিয়ার আলম। এ ছাড়াও বাঘা, লালপুর ও ঈশ্বরদীতে নামে-বেনামে শাহরিয়ার আলমের আরও জমির কেনার তথ্য পাওয়া গেছে।
অথচ শাহরিয়ার আলমের ২০০৮ সালের হলফনামায় দেওয়া তথ্যে তার কোন জমি ছিল না। আর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ছিল সব মিলিয়ে ২ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকার। পোশাক কারখানার নামে ঋণ ছিল ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ২৯ হাজার ৪২২ টাকা।
তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে নিজের নামে কৃষি ও অকৃষি জমি দেখিয়েছেন ৫১ বিঘা। অস্থাবর সম্পদ দেখান ৮৯ কোটি ২৪ লাখ ৯ হাজার ৯৭৩ টাকার। আর নিজের পোষাক কারখানার নামে থাকা ৭৬ কোটি টাকার ঋণও পরিশোধ দেখান। অর্থাৎ এই সময়ে তিনি অন্তত ১৬৫ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। ২০০৮ সালে তাঁর নামমাত্র গার্মেন্ট ছিল। বর্তমানে তার মালিকানাধীন গার্মেন্টের সংখ্যা আটটি।
এলাকাবাসী অভিযোগ করেন, ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর জমি ও অর্থসম্পদ পাহাড় গড়ে তোলার নেশায় শাহরিয়ার আলম তার নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক লুটপাট চালিয়েছেন। তিনি তার এপিএস সিরাজুল ইসলামের মাধ্যমে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন টিআর-কাবিখাসহ সরকারি সব অনুদান ও প্রকল্প। এমনকি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক নিয়োগেও করেন বাণিজ্য।
চাকরি, বদলিসহ বিভিন্ন কাজেও এপিএসের মাধ্যমে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। প্রতিমন্ত্রীর তহবিলে টাকা না দিলে কারও টিআর-কাবিখা বা সরকারি অনুদান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। আবার টাকা দিলে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেও মিলেছে সরকারি বরাদ্দ।
শাহরিয়ার আলম ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবার আওয়ামী লীগের এমপি নির্বাচিত হন। প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার সময় ২০০৮ সালে ১০ লাখ ৫ হাজার টাকা দামের হোন্ডা সিআরভি মডেলের গাড়িতে এবং স্ত্রী ২৭ লাখ টাকা দামের নিশান এক্স-ট্রায়াল গাড়িতে চড়তেন। সর্বশেষ তাকে ১ কোটি ১ লাখ ৩ হাজার ১০০ টাকা দামের লাক্সারি গাড়িতে এবং তাঁর স্ত্রীকে ১ কোটি ১৬ লাখ ২৫ হাজার ৫৭৫ টাকা দামের গাড়িতে চড়তে দেখা যায়।
নাটোরের লালপুরে শাহরিয়ার আলমের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়ি। সেখানকার স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার কন্যা সিলভিয়া পারভীন লেনিকে দ্বিতীয় বিয়ে করে প্রথম স্ত্রী আয়েশা আক্তার ডালিয়াকে তালাক দেন তিনি। এর পর দ্বিতীয় স্ত্রী লেনির মা রোকসানা মর্ত্তুজা লিলিকে ২০২১ সালে শাহরিয়ার আলম প্রভাব খাটিয়ে মেয়র বানান। লালপুরে স্ত্রীকে রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি করে দিয়েছেন শাহরিয়ার আলম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাঘা উপজেলার এক আওয়ামী লীগ নেতা জানান, গত ৪ আগস্ট বিকেলেও শাহরিয়ার আলম বাঘা উপজেলার আড়ানীর বাসায় ছিলেন। সন্ধ্যার পর থেকে আর কোনো নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি তিনি।
নিজের গাড়ি ঢাকায় পাঠিয়ে তিনি ৫ আগস্ট ভোরে বাঘার আরেক নেতার গাড়িতে চড়ে সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে গেদে বর্ডারে পৌঁছান। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। সেখান থেকে থাইল্যান্ড হয়ে এখন তিনি রাশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে।