ভারতের চন্দ্র বিজয়ের পটভূমি সবারই জানা। এক বছর আগে সফলভাবে চাঁদে মহাকাশযান পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল ভারত। এ কাজে দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন ভারতের মহাকাশ গবেষণাকেন্দ্র ইসরোর চেয়ারম্যান এস সোমনাথ। তিনি পেশায় একজন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার।
ভারতের এমন সফলতার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) চেয়ারম্যানকে নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। স্পারসোর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা, পড়াশোনা করেছেন কৃষিতে। স্পারসোর মতো একই দশা ছিল রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী একমাত্র সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের।
গত পাঁচ বছরে সংস্থাটিতে পাঁচজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে পদায়ন এবং বদলি হয়েছেন। তাদের সবাই ছিলেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। তারা বিমানের ‘ব’ বোঝার আগেই অন্যত্র বদলি হয়েছেন। ফলে বিমান তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেননি।
আমরা বিমানে যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। বিমানের সেবার মান বা সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই। সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছি। আশাকরি বিমানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গণমাধ্যমের মাধ্যমে শিগগির জাতিকে জানাতে পারবো।- মো. সাফিকুর রহমান
সম্প্রতি বিমানের এমডি ও সিইও পদে যোগ দিয়েছেন সংস্থাটির সাবেক পরিচালক (বিপণন ও বিক্রয়) ড. মো. সাফিকুর রহমান। বিমানে তার ৩৪ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বিমানে সর্বোচ্চ যাত্রীসেবা নিশ্চিত ও সংস্থাটিকে লাভজনক পথে নিয়ে যাবেন বলে প্রত্যাশা করছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।
১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠা হয়। এয়ারলাইন্সটির বয়স ৫২ বছর পার হলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। এর মূলে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও দক্ষ লোকের অভাব। অর্থাৎ, সংস্থাটির এমডি ও সিইও পদে পদায়ন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিজ্ঞতা না থাকায় বিমানের উন্নয়ন সম্ভব হয়নি। বিগত সময়ে যারা বিমানের এমডি ও সিইও হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন, তারা বিমানের খুঁটিনাটি বিষয় বোঝার আগেই অন্যত্র বদলি হয়েছেন। তাই এবার নতুন এমডি ও সিইও বিমানকে তার লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারবেন বলে সবাই প্রত্যাশা করছেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সূত্র জানায়, গত ৪ সেপ্টেম্বর ড. মো. সাফিকুর রহমানকে এমডি ও সিইও হিসেবে নিয়োগ দেয় বিমান পরিচালনা পর্ষদ। সাফিকুর রহমান ১৯৮৬ সালে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ট্রেইনি কমার্শিয়াল অফিসার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। তিনি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক প্রশাসন ও মানবসম্পদ, পরিচালক প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড লজিস্টিকস সাপোর্ট এবং পরিচালক বিপণন ও বিক্রয় হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি ট্যারিফ, মার্কেট রিসার্চ, রিজার্ভেশন, কার্গো প্রভৃতি শাখায় কাজ করেছেন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও গ্রিস স্টেশনে কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। দীর্ঘ পেশাগত জীবন শেষে তিনি ২০১৭ সালে অবসরে যান।
সাফিকুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন কুইন্সল্যান্ড থেকে মার্কেটিংয়ে এমবিএ এবং ২০১১ সালে সাউদার্ন ক্রস ইউনিভার্সিটি, অস্ট্রেলিয়া থেকে ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেন। ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টার থেকে তিনি অ্যাভিয়েশন নিয়ে একাধিক ডিপ্লোমা ও ট্রেনিং করেছেন।
দীর্ঘদিন ধরে বিমানে একজন প্রফেশনাল লোক চেয়েছি। যিনি বিমানে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। এতদিন পর ভালো একজন এমডি ও সিইও পেয়েছে বিমান। নিজেদের মধ্যে থেকে একজন অভিজ্ঞ লোককে নিয়োগ দিয়েছে।- অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম
আকাশপথে যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধি ও লোকসানে থাকা বিমান নিয়ে প্রত্যাশা জানিয়ে মো. সাফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিমানে যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধির চেষ্টা করছি। বিমানের সেবার মান বা সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই। সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছি। আশাকরি বিমানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গণমাধ্যমের মাধ্যমে শিগগির জাতিকে জানাতে পারবো।’
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রশাসন দপ্তর সূত্রে জানায়, ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় দেড় বছর বিমানের এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মো. মোকাব্বির হোসেন। তাকে সরিয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামালকে। তিনি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর আসেন যাহিদ হোসেন। তিনি সময় পান মাত্র পাঁচ মাস। ২০২২ সালের জুলাই মাসে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর তার মেয়াদ শেষ হয়।
২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর বিমানের এমডি ও সিইওর দায়িত্ব নেন শফিউল আজিম। তিনি ঢাকা-টরেন্টো, ঢাকা-নারিতা, ঢাকা-গুয়াংজু, ঢাকা-রোমসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রুট চালু করেন। এছাড়া শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব নেওয়া, বিমানের জন্য অত্যাধুনিক উড়োজাহাজ কেনাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেন তিনি। গত ২৯ মে তাকেও দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
পরে গত ৩০ মে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এমডি ও সিইও হিসেবে দায়িত্ব নেন মো. জাহিদুল ইসলাম ভুঞা। বিসিএস (প্রশাসন) ১৮তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা বিমানে যোগ দেওয়ার আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের একান্ত সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাই ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর জাহিদুল ইসলামকেও ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
বিমানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, বিমানের সিইও পদটি একটি অপারেশনাল পদ। কিন্তু গত পাঁচ বছরে বিমানের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে যে পাঁচজন এমডি-সিইও হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন তাদের চারজনই মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আমলা ছিলেন। প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক পরিচালনার অভিজ্ঞতা এবং বিমান শিল্পের সামান্য অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাদের এ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আবার বিমানের সার্বিক কর্মকাণ্ড আয়ত্তে নেওয়ার আগেই তাদের বদলি বা পদোন্নতি দিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়। ফলে বিমান তার যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে পারে না।
একটি এয়ারলাইন্সে অভিজ্ঞ এমডি ও সিইও নিয়োগ কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ— জানতে চাইলে বিমানের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বিমানে একজন প্রফেশনাল লোক চেয়েছি। যিনি বিমানে বিভিন্ন পদে কাজ করেছেন। এতদিন পর ভালো একজন এমডি ও সিইও পেয়েছে বিমান। নিজেদের মধ্যে থেকে একজন অভিজ্ঞ লোককে নিয়োগ দিয়েছে।’
‘এটি ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে নিজেদের লোক এমডি ও সিইও হওয়ার শুভ সূচনা হয়েছে। তবে নতুন এমডির সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে একটি দক্ষ টিম দরকার। যাদের মাধ্যমে বিমানের সব সেক্টর সমানভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি, বিগত সময়ে যারা বিমানে নিয়োগ বা পদন্নতি পেয়েছেন, তাদের বেশিরভাগই এসেছেন সুপারিশে। আজ যারা বড় বড় পদে আছেন, তারা সুবিধা পেয়ে এসেছেন। এজন্য তাদের মধ্যে থেকে দক্ষ লোক পাওয়া কঠিন হবে। তাই নতুন দক্ষ লোক নিয়োগে বিমানকে উদ্যোগ নিতে হবে।’