ঢাকা
২৫শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সকাল ১১:০১
logo
প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৪

কাজে ফিরতে চান শ্রমিকরা, উস্কানিতে তৃতীয় পক্ষ

বেতন বৃদ্ধি, বকেয়া পরিশোধ, টিফিন, ছুটি বৃদ্ধি, মাতৃকালীন সময়ে ভারী কাজ না করা, কোম্পানির লভ্যাংশের অংশ প্রদানসহ বেশ কিছু দাবি নিয়ে গত দুই সপ্তাহ ধরে সাভার ও আশুলিয়ায় আন্দোলন করছেন পোশাক শ্রমিকরা। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সব দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাসের পরও থামছে না শ্রমিকদের এই আন্দোলন। কারখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণ শ্রমিকরা আন্দোলন চান না। তারা তাদের দৈনন্দিন কাজে ফিরতে চান। কিন্তু বহিরাগত একটি পক্ষ দেশের শিল্পখাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তাদের উস্কানি দিয়ে আন্দোলনে নামিয়েছে। যার জেরে শুধু আশুলিয়াতেই ৮৬টি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে আরও ১৩৩টি পোশাক কারখানায়।

গতকাল সরজমিন আশুলিয়ায় গিয়ে দেখা যায়, টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের জামগড়া, কাঠগড়া, বেরণ, ছয়তলা, নরসিংহপুর, নিশ্চিন্তপুর, জিরাবো এলাকার শারমিন, হা-মীম, এ.এম ডিজাইন, এনভয় গার্মেন্টস, সেতারা, স্টারলিংকটালিক, মন্ডল নীটওয়্যারস লিমিটেড, সিগমা ফ্যাশনস লিমিটেড, ক্রশওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, জিন্স প্রোডিউসার লিমিটেড, অরুনিমা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড এবং ডিএমসি এ্যাপারেলস লিমিটেড, এস এম নীটওয়্যারস লিমিটেড, আগামী এ্যাপারেলস লিমিটেড, মানতা এ্যাপারেলস লিমিটেডসহ প্রায় বেশির ভাগ পোশাক কারখানা বন্ধ রয়েছে। কিছু কারখানার গেটে ছুটির নোটিশ টানানো রয়েছে। কিছু কারখানার গেটের সামনে আবার বড় সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ‘কারখানা বন্ধ’। কয়েকদিনের চলা আন্দোলনে পুরো এলাকা আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়েছে। ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে অনেকেই তার ভবনের সামনে বড় বড় অক্ষরে লিখে রেখেছেন ‘এটা পোশাক কারখানা না’। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও এলাকাটিতে টহল জোরদার করেছে।

নরসিংহপুর এলাকার এস.জি শারমিন গ্রুপের শারমিন এ্যাপারেলস লি. কারখানার সামনে গিয়ে দেখা যায়, কারখানার প্রধান ফটকে নোটিশ টানানো ‘সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হলো।’ শিল্পকলকারখানা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় নো-ওয়ার্ক নো-পে অর্থাৎ যতদিন কারখানা বন্ধ থাকবে ততদিনের মজুরি পাবেন না শ্রমিকরা। এরপরও প্রতিদিন কারখানার সামনে ভিড় জমাচ্ছেন অনেক শ্রমিক। শারমিন এ্যাপারেলসের গেটের পাশেই কথা হয় কারখানাটির শ্রমিক আরিফের সঙ্গে। তিনি বলেন, মঙ্গলবারও আমরা প্রতিদিনের মতো কারখানায় প্রবেশ করে কাজ করছিলাম। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কারখানার বাইরে সড়কে অন্য কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করলে আমাদেরকেও ছুটি দিয়ে দেয়া হয়। এরপর বুধবার সকালে এসে দেখি কারখানার গেটে বন্ধের নোটিশ। এখন কবে কারখানা খুলবে, কবে আমরা আবারো কাজে ফিরবো তার ঠিক নেই। তিনি বলেন, আমরা পেটের দায়ে এই কারখানায় কাজ করি। কাজ না করলে তো আর কেউ এসে আমাদের খাবার দিয়ে যাবে না। কাজ করে যেই টাকা পাই তা দিয়েই বাসা ভাড়া, বাচ্চার পড়া-লেখার খরচ দিয়ে সংসার চালাই। কিছু অসাধু লোকের জন্য আজকে আমাদের কারখানা বন্ধ রাখা হয়েছে। আমরা এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাই। হাফিজুর নামে আরেক পোশাক শ্রমিক বলেন, যেই হারে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে সেই হারে আমাদের বেতন বাড়েনি এটা সত্য। এখন এক কেজি পিয়াজের দাম ১২০ টাকা। মাস শেষে যেই বেতন পাই তা দিয়ে ভালোমতো আমাদের সংসার চলে না। কিন্তু আমরা যে টাকা-ই উপার্জন করি তা এই পোশাক কারখানা থেকেই। এই কারখানাই আমাদের রুটি-রুজি।

কারখানা বন্ধ হয়ে গেলে মালিকের কষ্ট হবে না, না খেয়ে মরবে না। কিন্তু এই কাজ বন্ধ হয়ে গেলে আমরা বৌ-বাচ্চা নিয়ে না খেয়ে মরবো। তাই আমরা আমাদের কাজে ফিরতে চাই। এ.এম ডিজাইন লিমিটেড কারখানার এক অপারেটর বলেন, সাধারণ শ্রমিকরা মূলত এসব আন্দোলন চায় না। তারা প্রতিদিন সকালে তাদের কাজে যোগ দিতে চান। কিন্তু আগে যারা এই শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করতো তারাই সরকার পতনের পর থেকে মাঠ গরম রাখতে বিভিন্ন দাবির কথা বলে সাধারণ শ্রমিকদের রাস্তায় নামাচ্ছেন। দেশের শিল্পখাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন তারা। আর এই জন্যই তারা নিয়মিত শ্রমিক কলোনিগুলোতে গিয়ে তাদের লোকদের নিয়ে মিটিং করছে। যারা কাজে যোগ দিতে চাচ্ছেন তাদেরকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখিয়ে আন্দোলনে নামতে বাধ্য করছে। গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে গেলেও তাদের কিচ্ছু যায় আসে না। হা-মীম গার্মেন্টের দুই নম্বর গেট এলাকায় কথা হয় নাসরিন নামে এক পোশাক শ্রমিকের সঙ্গে। কারখানা বন্ধ থাকলেও গতকাল তিনি গার্মেন্টসের সামনে এসেছিলেন। নাসরিন বলেন, দিনের বেশির ভাগ সময়টাই এই ফ্যাক্টরিতে কাটাই। সেই ফ্যাক্টরি কয়েকদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। কবে খুলবে ঠিক নেই। আমরা এখন কী করবো, কার কাছে যাবো বুঝতে পারছি না। নাসরিনও কাজে যোগ দিতে চান।

এনভয় গার্মেন্টস, সেতারা, স্টারলিংকটালিক, মণ্ডল নিটওয়্যারস লিমিটেড, সিগমা ফ্যাশনস লিমিটেডসহ টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের বেশ কয়েকটি কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা বলেন, আন্দোলন শুরু হলে বিশৃঙ্খলার ভয়ে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নেয়। এরপরও গত মঙ্গলবার সকালে শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করে শুধু হাজিরা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে চলে যান। এরপর বুধবার সকাল থেকেই সহিংসতা ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিবেচনায় শ্রম আইন অনুযায়ী আশপাশের ৮৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

এদিকে শারমিন, হা-মীম, মণ্ডল নিটওয়্যারস, সিগমা ফ্যাশনস, এস এম নিটওয়্যারসসহ বেশ কিছু পোশাক কারখানার একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শ্রমিকরা একের পর এক দাবি নিয়ে সামনে আসছেন। একটা পূরণ করলে তারা আরেকটা দাবি তুলছে। যা ন্যায্য তাও বলছে যার ন্যায্যতা নেই তাও উত্থাপন করছে। আবার অনেক গার্মেন্টস আছে সেখানে কখনোই কোনো ঝামেলা হয়নি। সেখানেও আন্দোলন হচ্ছে। এখন পর্যন্ত শ্রমিকরা তাদের ২১টি দাবির কথা কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। তাদের প্রায় সব দাবিই মালিকপক্ষ মেনে নিয়েছে। এখন তারা আরও নতুন নতুন দাবির কথা বলছে।

যা থেকে বোঝা যাচ্ছে এগুলো সবই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কেউ ভুল বুঝিয়ে তাদের রাস্তায় নামাচ্ছে। তারা বলেন, আন্দোলনের নামে বিভিন্ন গার্মেন্টসে যেই বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে তার সিসিটিভি ফুটেজ আমরা পর্যবেক্ষণ করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। ওই ফুটেজে দেখা গেছে, শ্রমিকদের মধ্য থেকে ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিকের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ রহস্যজনক। তারাই কারখানার ভেতরে নাশকতার চেষ্টা করেছে। প্রতিটি কারখানার শ্রমিকদের মধ্যেই এমন ১৫ থেকে ২০ জনের একটি দল রয়েছে। তাদেরকে আমরা এখনো শনাক্ত করতে পারিনি। তবে আমাদের ধারণা এই ১৫/২০ জনের সন্ত্রাসী দলটিই শ্রমিকদের ভিড়ে মিশে নাশকতার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের পেছনে আরও অনেকে আছে। তারা সকলে মিলে ষড়যন্ত্র করে ভুল বুঝিয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনের নামে রাস্তায় নামাচ্ছে।

গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফেডারেশনের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, কারখানা ভাঙচুর ও লুটপাটের সঙ্গে কোনো শ্রমিকের সম্পর্ক নেই। স্বার্থান্বেষী একটি মহল অরাজকতা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চায়।

এ বিষয়ে বিজিএমইএ’র জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে পোশাক শিল্পকে ধ্বংস করতে চক্রান্ত শুরু করেছে। বিদেশি ক্রেতাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা দিতে শ্রমিক আন্দোলনের এই নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে।
আমরা শ্রমিকদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছি। শ্রমিকরা আমাদের জানিয়েছেন, তারা তাদের কাজে ফিরতে চান। পরিস্থিতি ভালো হলে কারখানা মালিকরা ধাপে ধাপে তাদের কারখানা খুলবেন।

বিষয়টি নিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার এবং বিজিএমইএ সব পক্ষই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমরা তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। প্রশাসনও তাদের কাজ করছে। আশা করছি দু-একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।

আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেছেন, শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী ভার্চ্যুয়াল বটয়ম, মণ্ডল নিটওয়্যারস লিমিটেড, সিগমা ফ্যাশনস লিমিটেড, হা-মীম গ্রুপ, ক্রশওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, জিন্স প্রোডিউসার লিমিটেড, অরুনিমা গ্রুপের অরুনিমা স্পোর্টসওয়্যার লিমিটেড এবং ডিএমসি এ্যাপারেলস লিমিটেড, এস এম নিটওয়্যারস লিমিটেড, আগামী এ্যাপারেলস লিমিটেড, মানতা এ্যাপারেলস লিমিটেডসহ আশুলিয়ায় মোট ৮৬টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ও ১৩৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। তবে, এখনো কোথাও তেমন কোনো বিশৃঙ্খলার খবর পাওয়া যায়নি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী কাজ করছে।

logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram