জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে চলা কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঢাকায় প্রায় চার শ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। মারা যাওয়া এসব মানুষের অনেকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। ঢাকার তিনটি সরকারি হাসপাতালের মর্গ থেকে পুলিশ এসব মরদেহ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দিয়েছে। পরে সংস্থাটি সেগুলো দাফনের ব্যবস্থা করে।
সংস্থাটির দেওয়া তথ্য মতে, জুলাই মাসে তারা পরিচয়হীন ৮১ জনের মরদেহ দাফন করেছে, যা অন্যান্য মাসের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি জানান, এরা সবাই আন্দোলনে গিয়ে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে তা-ও নয়, কেউ ছিল ফুটপাতের হকার, কেউ পথচারী কিংবা ভবঘুরে। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে এরা মারা গেছে।
গত বুধবার কাকরাইলের আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে গেলে দেখা যায়, ভবনটির নিচতলার নোটিশ বোর্ডে জুলাই ও আগস্টে দাফন করা ১১৫ জনের ছবি।
বোর্ডের ওপরে লেখা আছে, ‘আঞ্জুমান কর্তৃক দাফনকৃত বেওয়ারিশ লাশের ছবি’। নিচে ক্যাপশনে হাসপাতালের নাম ও মৃত্যুর তারিখ লেখা।
বোর্ডে থাকা ১১৫টি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ফরেনসিক ও ইমার্জেন্সি মর্গ থেকে মরদেহ এসেছে ৬৫টি, সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে ২১টি, মিটফোর্ড মেডিক্যাল ফরেনসিক, ইমার্জেন্সি মর্গ থেকে ১৭টি, গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিক্যাল কলেজ মর্গ থেকে আটটি এবং কমলাপুর রেলওয়ে এলাকা, পোস্তগোলা ও শ্মশানঘাট এলাকা থেকে চারটি।
বোর্ডে টানানো ছবির মধ্যে পাঁচটি নবজাতক ও ১৩ জন নারীর ছবিও রয়েছে। ৩০ জনকে অক্ষত দেখা গেলেও অন্যদের মুখমণ্ডল ছিল রক্তাক্ত।
আঞ্জুমান মুফিদুলের দাফনসেবা কর্মকর্তা কামরুল আহমেদ জানান, এর আগের ছয় মাসে যথাক্রমে ৪৪, ৩৩, ৪৯, ৩৭, ৫৯, ৪৮টি পরিচয়হীন মরদেহ দাফন করেছেন তাঁরা। আগস্টে দাফন হয়েছে ৩৪ জনের মরদেহ।
৬ আগস্ট সকাল ১১টা। রিকশায় করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে একটি মরদেহ আসে।
জানা যায়, হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে দুই দিন পড়ে থাকার পর মরদেহটি নিয়ে এসেছেন ইব্রাহিম নামের এক ব্যক্তি।
ইব্রাহিম মিয়া বলেন, ‘৪ আগস্ট রাত থেকে মরদেহটি ব্রিজের ওপর পড়ে আছে। কেউ ধরেনি। দেখে আমার ভীষণ মায়া হলো, তাই মর্গে নিয়ে এসেছি।’
ওই দিন অ্যাম্বুল্যান্সচালক তপু সরকারও পরিচয়হীন একটি মরদেহ নিয়ে আসেন ঢাকা মেডিক্যালে। তিনি বলেন, রাস্তায় তো কেউ আর লাশ খোঁজে না, সবাই আসে হাসপাতালে। যদি মৃত ব্যক্তির স্বজনরা এখানে আসেন।
হাসপাতালে আনা এমন পরিচয়হীন মরদেহের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে যাবে বলে জানান ঢাকা মেডিক্যালের মর্গ সহকারী রামুচন্দ্র দাস।
তিনি বলেন, মর্গের নিবন্ধন খাতায় এসব মরদেহের নাম-ঠিকানার জায়গায় লেখা রয়েছে ‘অজানা’। মর্গে অনেক মরদেহ তিন-চার দিন থাকার পর স্বজনরা এসে শনাক্ত করেছেন। তাদের পরিচয় লিখে রাখছেন তাঁরা। ১০ দিন অপেক্ষা করেও যেসব মরদেহের পরিচয় পাওয়া যায়নি, তাদের ডিএনএ পরীক্ষা শেষে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে দেওয়া হয়েছে।
আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের ট্রাস্টি ও সহসভাপতি আজিম বখ্শ বলেন, ‘মরদেহ থানায় আছে, এটা অনেক সময় স্বজনরা জানেন না। গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাঁদের জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’
এদিকে মৃতদেহ সৎকার করা রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের আল মারকাজুল ইসলামের তথ্য বলছে, জুলাই মাসে চার শতাধিক মানুষের মৃতদেহ সৎকার করেছে তারা। সংস্থাটি স্বাভাবিক সময়ে গড়ে ৩০০ সৎকার করে থাকে।
আল মারকাজুল ইসলামের জনসংযোগ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় জুলাই ও আগস্ট মাসে সৎকার অনেক বেশি ছিল। তবে এদের কতজন আন্দোলনে নিহত ছিল এ নিয়ে আমরা আলাদা কোনো তথ্য সংগ্রহ করিনি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে সারা দেশে অন্তত ৬৩১ জন নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ১৯ হাজার ২০০ জনের বেশি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে অন্তত ৪৫০ জনকে হাসপাতালে আনা হয়েছে মৃত অবস্থায়। বাকি ১৮১ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে।
আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে (১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট) ঢাকায় মৃত্যু হয় ২৪৬ জনের। দ্বিতীয় পর্যায়ে (৩ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে) ঢাকায় মৃত্যু হয়েছে ১২৬ জনের। এই সময়ে যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, রামপুরা ও বাড্ডা এলাকায় মৃত্যু বেশি হয়েছে।