আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হয়রানিমূলক মামলার কারণে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের হাজারো নেতাকর্মী ছিলেন ঘরছাড়া। একজনের নামে শতাধিক মামলা—এমন নেতাকর্মীও অনেক। এসব মিথ্যা মামলার কারণে সরকারি চাকরি হয়নি অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর। গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক কারণে করা এসব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও শৃঙ্খলা) আতাউর রহমান খান বলেন, রাজনৈতিক কারণে করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করেছে জননিরাপত্তা বিভাগ। এ কাজ শুরু করার জন্য শিগগিরই জেলা কমিটির কাছে চিঠি পাঠানো হবে। জেলা কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি চূড়ান্ত নেবে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এসংক্রান্ত কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমতি লাগে। আজ বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিটি দুটির অনুমোদন দিতে পারে। এরপর আগামী সপ্তাহ থেকে কাজ শুরু করবে জেলা কমিটি। সর্বশেষ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি হয়রানিমূলক রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আন্ত মন্ত্রণালয় ও জেলা কমিটি গঠন করা হয়।
তখন বিএনপি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়। সে হিসাবে এই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এবার অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিএনপি ও জামায়াত রাজনৈতিক কারণে করা মামলা তুলে নেওয়ার দাবি জানায়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও অন্যান্য কারণে রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও নিরীহ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়। এসব মামলা প্রত্যাহার করার জন্য সুপারিশ করার লক্ষ্যে সরকার জেলা ও মন্ত্রণালয় পর্যায়ে দুটি কমিটি গঠন করেছে।
জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হবেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক, সদস্যসচিব অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সদস্য পুলিশ সুপার (মহানগর এলাকার জন্য পুলিশের একজন ডেপুটি কমিশনার) ও পাবলিক প্রসিকিউটর (মহানগর এলাকার মামলার জন্য মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর)।
মামলা প্রত্যাহারের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা কমিটির সভাপতি ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদনপত্র দিতে হবে। এর সঙ্গে এজাহার ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চার্জশিটের (অভিযোগপত্র) সার্টিফায়েড কপি দাখিলের কথা বলা হয়েছে। আবেদনপ্রাপ্তির সাত কর্মদিবসের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দরখাস্তটি জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরের (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর) কাছে মতামতের জন্য পাঠাবেন।
এরপর ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে পাবলিক প্রসিকিউটর বা মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর তাঁর মতামত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠাবেন। পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত সংগ্রহপূর্বক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনটি সাত কর্মদিবসের মধ্যে জেলা কমিটির সভায় উপস্থাপন করবেন। জেলা কমিটির কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে মামলাটি রাজনৈতিক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হয়রানির জন্য করা হয়েছে, তাহলে তা প্রত্যাহারে সরকারের নিকট সুপারিশ করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এই সুপারিশ, মামলার এজাহার, চার্জশিটসহ আবেদনপ্রাপ্তির ৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে।
জেলা কমিটির সুপারিশপ্রাপ্তির পর মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি সুপারিশগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। এরপর প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা করে মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম শুরু করবে বলে জানা গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪-এর আওতাধীন মামলাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা কমিশনের লিখিত আদেশ ছাড়া প্রত্যাহার করা যায় না। কারণ দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট এক্ট ১৯৫৮-এর ১০(৪) ধারায় এ বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ কারণে এ ধরনের মামলা চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করতে হবে। এ ধরনের মামলার বিষয়ে করণীয় পরে নির্ধারণ করা হবে।
মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হবেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সদস্যসচিব জননিরাপত্তা বিভাগের একজন কর্মকর্তা, সদস্য জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, অতিরিক্ত সচিব (আইন ও শৃঙ্খলা), যুগ্মসচিব (আইন) এবং আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি।
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী মামলা প্রত্যাহারের এখতিয়ার সরকারের রয়েছে। সে হিসেবে যেসব মামলা হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে হয়রানিমূলক মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হবে।
হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলার কারণে সরকারি চাকরি হয়নি অনেক মেধাবী শিক্ষার্থীর। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২৮তম থেকে ৪২তম বিসিএসে বঞ্চিত ২৫৯ জন বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ও হয়রানিমূলক মামলার কারণে প্রায় ৫০ জনের এখনো নিয়োগ হয়নি। তাঁরা এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
৩৫তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের বঞ্চিত কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিসিএস উত্তীর্ণ হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ না পাওয়া কর্মকর্তারা বিভিন্ন ক্যাডারে যোগদান করেছেন। কিন্তু যাঁদের নামে হয়রানিমূলক মামলা রয়েছে, তাঁদের এখনো নিয়োগ হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের নিয়োগ হবে না। তাই এসব মামলা দ্রুত প্রত্যাহার করা উচিত।
বিএনপির মামলার তথ্য ও সংরক্ষণ শাখার তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি ও এর অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গত ১৫ বছরে এক লাখ ৩৮ হাজার ৭১টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার আসামির সংখ্যা ৪০ লাখের ওপর। জামায়াতসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও এভাবে মামলা করা হয়। শতাধিক মামলার আসামি—এমন নেতাকর্মীদের প্রায় সবাইকে ঘুম থেকে উঠেই আদালতে আসতে হয়।