গত দুই সপ্তাহে সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায়, হাসপাতালগুলোয় রোগীর চাপ বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বর্তমানে সারা দেশে দুই হাজার ৭৭২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি এক হাজার ৪৩৭ জন।
শয্যার বিপরীতে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ায় অনেকের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের মেঝে ও করিডরে।
আবার অনেকে হাসপাতালে শয্যার বেশি রোগী ভর্তি না করায় তারা ফেরত যাচ্ছে। আক্রান্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রাজধানীর হাসপাতালগুলো। ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালে ভর্তি রোগী, রোগীর স্বজন, নার্স ও হাসপাতাল পরিচালকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
ঢাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ছয়জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
হাসপাতালটিতে এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়ে ১৯ জনের।
হাসপাতালটির পরিচালক ডা. এস এম হাসিবুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ৯১ জন। বেশির ভাগ রোগী আসছে জ্বর, শরীর ব্যথা বা মাথা ব্যথা নিয়ে। তবে এবার নতুন কিছু উপসর্গও দেখা যাচ্ছে।
অনেকের পেট ও লিভারের সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য মতে, এ পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছে এক হাজার ২৪১ জন, মারা গেছে ২৮ জন। গতকাল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মেডিসিন বিভাগের চতুর্থ তলায় শুধু পুরুষ রোগীদের ডেঙ্গু ওয়ার্ড করা হয়েছে। এ ওয়ার্ডে শয্যার বাইরে বারান্দায় সিঁড়িকোঠায় মেঝেতে অনেক রোগী ভর্তি আছে। রোগীদের জন্য কোনো মশারির ব্যবস্থা হয়নি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত এক সপ্তুাহের ব্যবধানে ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ১২ থেকে ৩০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি।
এদিকে গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ডেঙ্গু পরিস্থিতির সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার তথ্যে বলা হয়েছে, নতুন ৮৬৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছে। মারা গেছে দুজন। এ নিয়ে ডেঙ্গুতে এ বছর মৃত্যুর সংখ্যা ১৩৩ জনে পৌঁছালে। এর মধ্যে ২১ জনই শিশু।
চলতি বছর ডেঙ্গুতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ২৪ হাজার ৯০০ জন। আক্রান্ত রোগীদের বয়সভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি। যা মোট আক্রান্তের ৪১.৬৮ শতাংশ। ১৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ১৯.০৬ শতাংশ। ৩১ থেকে ৪৫ বছরে ২৩.৩০ শতাংশ। ৪৬ থেকে ৬০ বছরে ১১.১০ শতাংশ এবং ষাটোর্ধ্ব ৪.৮৬ জন।
অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি, যা মোট মৃত্যুর ২৯.৩২ শতাংশ। ১৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে ১৫.৭৮ শতাংশ। ৩১ থেকে ৪৫ বছরে ১৮.৭৮ শতাংশ। ৪৬ থেকে ৬০ বছরে ১৫.৭৮ শতাংশ ও ষাটোর্ধ্ব ২০.৩০ জন।
জনস্বাস্থ্য ও কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়টাকে ডেঙ্গুর মৌসুম ধরা হয়। এই সময় বৃষ্টিপাত, বাতাসের আর্দ্রতা ও তাপমাত্রা এডিস মশা প্রজননের উপযোগী হওয়ায় ডেঙ্গুর বিস্তার ও মৃত্যু বেশি হয়।
তাঁরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গু পরিস্থিতি পুরোপুরি বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভর করছে। তবে পরিস্থিতি যে খুব বেশি ভালো হবে না, তা বোঝা যায়। এর পেছনের কারণের মধ্যে রয়েছে কোথায় এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি কত—তা জানতে বর্ষা জরিপ হয়নি। এতে মশা নিধন কার্যক্রম যথাযথ হয়নি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু রোগীর সঠিক তথ্য ও সংখ্যা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
অক্টোবরে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরো খারাপের শঙ্কা
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘আমাদের ফোরকাস্টিং মডেল (পূর্বাভাস) বলছে, অক্টোবর মাসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপ থাকবে। আক্রান্ত ও মৃত্যু দুটিই বাড়বে।’
কবিরুল বাশার বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সিটি করপোরেশনগুলোকে মশক নিধনে কার্যকর বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থায় জোর দিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কাজ হবে, রোগীর সঠিক তথ্য দেওয়া, রোগী ঠিকানা অনুযায়ী ২০০ মিটারের মধ্যে ক্রাশ কর্মসূচি করতে হবে। উড়ন্ত এডিস মশাগুলো ও লার্ভা ধ্বংস করতে হবে।
মশক কর্মসূচি বন্ধ হওয়ার শঙ্কা বেড়েছে
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, এ বছর শুরু থেকে মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা থাকলেও মাঝে সেটি ব্যাহত হয়েছে। বিশেষ করে গত দেড় মাস সেই অর্থে জোরালো মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়নি বা নেওয়া যায়নি। যে কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।
ডেঙ্গু মোকাবেলায় কাজ করবে ১০ টিম
চলতি মৌসুমে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম সমন্বয় ও তদারকির জন্য ১০টি টিম গঠন করেছে সরকার। গতকাল এক জরুরি সভায় এসব টিম গঠনের কথা এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গু মোকাবেলায় চারটি টিম এবং উত্তর সিটির জন্য তিনটি টিম কাজ করবে। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য সিটি করপোরেশনের জন্য গঠন করা হয়েছে একটি টিম।
প্রতি টিমে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাকে প্রধান করা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিদিন কমপক্ষে তিনটি ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাব এলাকা পরিদর্শন করে ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম তদাকর করবেন।