আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশের প্রধান বিচারপতি, আপিল বিভাগের বিচারপতি, অ্যাটর্নি জেনারেল, পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন সরকারি দপ্তর, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক রদবদল দেখা গেছে। আর এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের অপসারণের দাবি উঠেছে। এদিকে আইনজীবীরা রাষ্ট্রপতির অপসারণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দু’জন কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হঠাৎ করে একই সঙ্গে মো. সাহাবুদ্দিনকে অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অপসারণের দাবি জানিয়েছেন। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর সমন্বয়করা যখন-ই দাবি তুলেছেন তখন-ই রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আসতে দেখা গেছে।
সরকার এবারও তাদের দাবি মেনে নিয়ে রাষ্ট্রপতি অপসারণের পথে হাঁটবে কি? অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হলে তিনি ‘এখনই’ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না।
রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবি কেন?
মূলত, বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একটি পোস্টে সর্বপ্রথম এ দাবির কথা জানান। তার কয়েক ঘণ্টা পর সমন্বয়ক সারজিস আলমও তার ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইল থেকে একই কথা লিখে পোস্ট করেন।
এরপর-ই এই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের দু’জনের পোস্টেই মোট পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের বাইরে বাকি চারটি দাবি হল– ‘আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিতকরণ, নতুন সংবিধান গঠন, আওয়ামী দুর্নীতিবাজ আমলাদের পরিবর্তন ও হাসিনার আমলে করা সব অবৈধ চুক্তি বাতিল।’
ঠিক কী কী কারণে তারা হঠাৎ করে এসব দাবি, বিশেষ করে রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবি তুলেছেন, এ বিষয়ে জানতে শুক্রবার (৪ অক্টোবর) দিনভর উভয়ের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের কেউই কোনো সাড়া দেননি।
পরবর্তীতে একপর্যায়ে কথা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদের সঙ্গে। তিনি জানান, তারা সবাই ওই দাবির সঙ্গে একমত।
সেক্ষেত্রে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আসলে ঠিক কী কারণে রাষ্ট্রপতির অপসারণ চাচ্ছেন?
এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন হইছে। তাই, ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্ধারিত রাষ্ট্রপতি থাকলে তা যেকোনো সময় রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে।’
‘এই কারণে আমরা মনে করি, ওনাকে সহজ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সসম্মানে কিভাবে বিদায় দেওয়া যায়, সেদিকটা নিয়ে ভাবা উচিত। উনি ফ্যাসিজমের একটি সিম্বল। সেই সিম্বলটা থাকা উচিত না।’
হাসিনা সরকার পতনের প্রায় দুই মাস পর কেন এখন এই দাবি তুলছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর আগেও তারা বলেছিলেন। তবে এখন তারা জোরালোভাবে বলছেন।
এখন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের দাবি মেনে সরকার যদি সত্যিই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে চায়, তবে তারা কোন পথ অবলম্বন করবে?
আইনজীবীরা বলছেন, এই মুহূর্তে সেটি একটি বড় প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়াবে। কারণ এই সরকারের আইনগত বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন আছে। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে হয়। বাংলায় যাকে বলে অভিশংসন।
একাধিক সিনিয়র আইনজীবী মন্তব্য করেছেন, অভিশংসনের জন্য ‘সংসদ লাগবেই’। তবে রাষ্ট্রপতি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করলে তখন আর সংসদ লাগবে না, জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি যদি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন বা মৃত্যুজনিত কারণে পদ শূন্য হয়, তখন স্পিকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্পিকার-সংসদ কোনোটাই নেই।
সেই সঙ্গে, স্পিকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে ‘ওই সংসদ দ্বারাই নতুন রাষ্ট্রপতি’ নির্বাচন করতে হবে। ‘অতএব, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের জন্য বৈধ কোনো পন্থা নাই।’
তাহলে বর্তমান সরকার রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করতে পারবে কি না এবং পারলে তা কীভাবে, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী ওই সুযোগ নাই। রাষ্ট্রপতি এখন স্বেচ্ছায় বা কারো কথায় চলে যেতে পারেন।’
‘কারো কথায় যাওয়া অসম্ভব কিছু না। ক্ষমতায় যারা আছেন, তারা বললেই চলে যাবে। সেনাবাহিনী ও সরকার চাইলে এক সেকেন্ডের ব্যাপার,’ বলছিলেন তিনি।
‘আর এখানে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই। কারণ ফর্মেশন অব গভর্নমেন্ট-ই তো লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে না। কাজেই, ওই সুযোগ নাই। এখানে যা হবে, এমনিতে হবে। তবে এগুলোকে পরবর্তীতে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে অনুমতি দিতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে কথা হয় ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামে একটি সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক ও সিনিয়র আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুমের সঙ্গেও। তিনিও বলেন, ‘এখন অস্বাভাবিক সরকার কাজ করছে, তাই সংবিধানের মধ্য দিয়ে বৈধতা-অবৈধতা সাংবিধানিক পদ্ধতিতে খুঁজে পাওয়া কঠিন।’
‘তবে সেটাও তারা কাভার করার জন্য আপিল বিভাগ থেকে একটি রেফারেন্স (প্রাসঙ্গিক মতামত বা সুপারিশ) করে নিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত তারা সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে চলার চেষ্টা করছেন। যা সঙ্গতিপূর্ণ না, সেগুলো রেফারেন্সের মাধ্যমে। তাই, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের পদ্ধতি কী হবে, সেটার জন্য তাদেরকে এখন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে রেফারেন্স নিতে হবে।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা