মহামারী কোভিড-১৯ এর সময় আলোচনায় আসে গণস্বাস্থ্যের কিট আবিষ্কারের খবর। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান নির্বাহী ও অণুজীববিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল এই কিট আবিষ্কার করেন। বিদেশ থেকে কয়েক গুণ বেশি টাকায় কিট আমদানী করে তখন পরীক্ষা চলছিল। এই খবরে দেশবাসীর মনে স্বস্তির বাতাস বইলেও, খুশি হয়নি দেশের শীর্ষ ধনী সালমান এফ রহমান। তিনি কিটের ফর্মূলা নিজের প্রতিষ্ঠানে আনতে করেন নানা কারসাজি। নিজের প্রভাব দেখিয়ে থামিয়ে দেন আবিস্কার হওয়া কিটের বাজারে আসার সকল পথ। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই কিট আজও আলোর মুখ দেখেনি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গণস্বাস্থ্যের কিটের ফলাফল এমনকি আইসিডিডিআরবিতে পরীক্ষার পুরো তথ্য গোপন করেছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) শীর্ষ কর্মকর্তারা। ন্যাশনাল আডভাইজারি কমিটির সদস্যরাও এই পরীক্ষা ও ফলাফলের ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন তারা। আর এসবের মূলে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।
জানা গেছে, কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য ২০২০ সালে ৫০০ কিট বিএসএমএমইউতে জমা দেয় গণস্বাস্থ্য। ১৭ জুন সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন বিএসএমএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়–য়া বলেন, ‘এই কিট উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের রোগ শনাক্তকরণে কার্যকর নয়। উপসর্গের প্রথম দুই সপ্তাহে এই কিট ব্যবহার করে শুধু ১১ থেকে ৪০ শতাংশ রোগীর রোগ শনাক্ত করা সম্ভব। এর মাধ্যমে ৭০ শতাংশ রোগী, যাদের ইতোপূর্বে কোভিড-১৯ হয়েছিল, তাদের শনাক্ত করা সম্ভব।’
কিট পরীক্ষার পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্যের কিটের বিজ্ঞানসম্মত মূল্যায়ন কমিটির প্রধান বিএসএমএমইউয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. শাহীনা তাবাসসুম বলেন, আমাদের আইআরবির (রিসার্চ রিভিউ বোর্ড) অনুমতি নিয়ে পরীক্ষা হয়েছে। তবে সে সময় অনেক চাপ ছিল, দেরি হওয়ায় আক্রান্তের সর্বোচ্চ ২৮ দিন পর্যন্ত নমুনা নেওয়া হয়েছিল। আমরা মনে করি, একেবারে বিশ্বমানের না হলেও সেই পর্যায়ের কাছাকাছি ছিল।
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. রুবহানা রাকিব ‘পারফরম্যান্স ইভালুয়েশন অব জিআর কোভিড-১৯ রেপিড ডট ব্লট আইজিজি অ্যান্টিবডি কিট অ্যান্ড জিআর কোভিড-১৯ এলাইজা আইজিজি কিট উইথ আদার ইইউএ-সার্টিফাইড কিটস ফর ডিটেকশন অব অ্যান্টিবডিস এগেইনস্ট কোভিড-১৯’ শীর্ষক গবেষণাটি করেন।
গবেষণায় দেখা যায়, জিআর কোভিড-১৯ এলাইজা কিটটি ৯৭ দশমিক ৮ শতাংশ সেনসিটিভিটি (কতটা সঠিকভাবে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে সক্ষম) ও ৯৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ স্পেসিফিসিটি (কতটা সঠিকভাবে নীরোগ ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে সক্ষম) অর্জন করেছে। অন্যদিকে জিআর কোভিড-১৯ রেপিড ডট ব্লট কিটটি ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ সেনসিটিভিটি ও ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ স্পেসিফিসিটি অর্জন করেছে। আন্তর্জাতিক এই গবেষণা কেন্দ্রের ফলাফল ওই বছরের ১২ আগস্ট ডিজিডিএতে জমা দেয় আইসিডিডিআরবি।
আইসিডিডিআরবির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. রুবহানা রাকিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএর করোনার কিটের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নির্দিষ্ট একটি গাইডলাইন প্রায় শতভাগ মেনে গবেষণাটি করা হয়েছে। চার মাসের এই গবেষণায় ১৬০ জন প্রাপ্তবয়স্কের নমুনা নেওয়া হয়। যেখানে উপসর্গ দেখা দেওয়ার এক সপ্তাহ থেকে শুরু করে ৩ সপ্তাহ, এক মাসের বেশি উপসর্গ বহনকারী, উপসর্গহীন ব্যক্তি এবং নিউমোনিয়া ও ডেঙ্গুর রোগীদের মধ্যে ফলস পজিটিভ রিপোর্ট দেওয়া (আক্রান্ত নন কিন্তু রিপোর্টে শনাক্ত দেখানো) এমন রোগীর নমুনাও নেওয়া হয়েছে।
ড. রুবহানা রাকিব বলেন, ‘গবেষণা শেষ করে আরেকটা ল্যাবে পাঠানো হয়। তারা সবকিছু দেখে পাঠালে আমাদের আইআরবিতে পাঠাই। তারা অ্যানালাইসিস করে জানালে দুটো রেজাল্ট মিলিয়ে দেখা যায়- এটা খুবই ভালো মানের কিট, আমরা ভেবেছিলাম সস্তায় নিজেদের কিট দিয়ে কোভিড শনাক্ত করতে পারব। তবে কেন অনুমোদন পেল না আমরা জানি না।’
এদিকে অভিযোগ রয়েছে আইসিডিডিআরবির গবেষণায় গণস্বাস্থ্যের কিটের এমন অভূতপূর্ব ফলাফলের তথ্য গোপন করেছে ডিজিডিএ। এমনকি এই পরীক্ষার ব্যাপারে সরকারের ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটির সদস্যরাও জানেন না বলে জানান।
অ্যাডভাইজরি কমিটির একজন সদস্য চিকিৎসাবিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ডিজিডিএর ২০১৪ সালের একটা গাইডলাইন রয়েছে। গণস্বাস্থ্যের কিট নিয়ে কোনো গবেষণা আইসিডিডিআরবি করে থাকলে সেটি ন্যাশনাল অ্যাডভাইজরি কমিটি হয়েই আসতে হবে। কিন্তু এমন গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। হয়ে থাকলে তৎকালীন ওষুধ প্রশাসনের মহাপরিচালক বলতে পারবেন।
অন্যদিকে এ বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইসিডিডিআরবি তাদের গবেষণার ফলাফল জমা দিলে সিদ্ধান্তের জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে একটি ফাইল পাঠান ডিজিডিএর তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান। তবে সেই ফাইল আর ফেরেনি। এখন পর্যন্ত সেখানেই আটকা রয়েছে।
জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পরিচালক ডা. মুহিব-উল্লাহ খোন্দকারবলেন, আইসিডিডিআরবির ফলাফল জানার পর পুরো প্রকল্পটাই কিনতে চেয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। এ জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে জাফরুল্লাহ চৌধুরী কিট ৩০০ টাকায় বিক্রির কথা জানান। তখনই সালমানের আগ্রহ কমে গেছে। কারণ এটিতে দেশের উপকার হলেও তাদের খুব বেশি লাভ হবে না। তারা দেশের বাইরে থেকে আনলে বেশি ডলার পাচার করতে পারবেন, বেশি লাভবান হবেন। তাই তিনি অনুমোদন প্রক্রিয়া আটকে দেন। আজ পর্যন্ত সেই ফাইল মন্ত্রণালয়ে আটকা রয়েছে। কিটটি বাজারে আনতে পারলে শুধু দেশেরই উপকার হতো তাই নয়, অন্যান্য দেশ থেকেও আমাদের দেশে টাকা আসত। অনুমোদন না মেলায় আশা ছেড়ে দেন ডা. জাফরুল্লাহ। এমনকি দেশে থেকে চলে যেতে বাধ্য হন ড. বিজন।
অপর দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এটি অনেকটা গোপন ফাইল হিসেবে ছিল। পুরোটাই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পরিচালক সালাহউদ্দিন। বর্তমানে অফিসে সেই ফাইল নেই। অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি। তৎকালীন মহাপরিচালক ও পরিচালক মিলে এই ফাইল উধাও করে দিয়েছেন বলে তাদের ধারণা।
সংস্থাটির বর্তমান মুখপাত্র ও পরিচালক ড. মো. আকতার হোসেন এ ব্যাপারে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।