গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর তার সরকারের মন্ত্রী এমপি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তাহের হিড়িক পড়ে। এর মধ্যেই বিগত সরকারের রাঘব বোয়াল খ্যাত মন্ত্রী এমপি নেতাদের আটক করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। তাদের জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে জেলে প্রেরণ করছে আদালত। এছাড়া আটক অবস্থায় এদের বিরুদ্ধে আরও মামলা দায়ের করা হচ্ছে। কিন্তু বিপরীত চিত্র সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরির ক্ষেত্রে।
বিগত সরকার পতনের আওয়ামী লীগের যে মন্ত্রী-এমপিরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাদের মধ্যে একমাত্র সাবের চৌধুরীই জামিন পেলেন। তাঁকে দ্রুত জামিন ও মুক্তি দেওয়ার ঘটনাটিও বিরল। হত্যা মামলায় রিমান্ডে পাঠানোর পরদিনই ছয় মামলায় জামিন দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে হাজতখানা থেকে সাবেরকে মুক্তি দেওয়া হয়।
সে সময় সাংবাদিকরা বিভিন্ন প্রশ্ন করলেও সাবের কোনো উত্তর দেননি। তার আইনজীবী মোরশেদ হোসেন শাহীন পাশ থেকে বলেন, সাবের চৌধুরী অসুস্থ।
পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে কালো রঙের একটি গাড়িতে করে সাবের চৌধুরী আদালত এলাকা ছাড়েন।
গতকাল মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) এ ঘটনা ঘটে। এতে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। আর সাবের হোসেন চৌধুরীর মুক্তি নিয়ে জনমনে নানা কৌতূহল দেখা দিয়েছে। সারাদেশের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিষয়টি।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, সাবেরের জামিন আদেশের পর আদালত কক্ষেই বিক্ষোভ করেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা। তাদের কাউকে কাউকে বিচারকের উদ্দেশে গালমন্দ করতেও দেখা গেছে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না অবশ্য এ ঘটনায় আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি খুবই ভালো লক্ষণ। অপরাধ যা-ই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্যগত কারণে যে কেউ জামিন পেতে পারেন, যেটা আদালত বিবেচনায় নিয়েছেন। আরও যারা কারাগারে রয়েছেন, তারাও জামিন পাবেন–এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
এদিকে সাবেরের মুক্তির পেছনে কোনো রহস্য আছে কিনা, এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীও মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কেউ কেউ আশাবাদী হলেও অনেকে অতীত রাজনীতির ইতিহাস বিবেচনায় সাবেরের জামিন পাওয়ায় বিশেষ কোনো ‘রাজনৈতিক সমঝোতার’ গন্ধ খুঁজছেন।
সাবেরের ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, ৫ আগস্টের পর শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য, এমপি, জ্যেষ্ঠ নেতা, এমনকি আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীও গা-ঢাকা দিয়েছেন। সেখানে সাবের তার রাজধানীর পরীবাগের বাসাতেই ছিলেন। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাঁকে গুলশান থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী জানিয়েছেন, সাবেক মন্ত্রীদের মধ্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সাধারণ মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। সাবেরের মুক্তির দাবিতে এমন বিক্ষোভের কোনো ঘটনা জানা যায়নি। এ ছাড়া শাজাহান খান, রমেশ চন্দ্র সেন, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, আসাদু্জ্জামান নূর, সাধন চন্দ্র মজুমদার, অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজনসহ বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী অসুস্থ ও বয়স্ক বিবেচনায় জামিন আবেদন করেও সুফল পাননি। এমন প্রেক্ষাপটে হঠাৎ একজনের জামিন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, সাবের হোসেন চৌধুরী সারাবিশ্বের সংসদ সদস্যদের সংগঠন ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। দেশের রাজনীতিতেও তাঁর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে। পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে তাঁর চমৎকার বোঝাপড়া। আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের রয়েছে অব্যাহত সমর্থন। তাঁর মুক্তিতে এই শক্তির প্রভাব থাকতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, আইনে বিচার পাওয়ার অধিকার সবারই আছে। কিন্তু একজন হত্যা মামলার আসামি এত দ্রুত ছাড়া পেলে তা খারাপ বার্তা বয়ে আনে। এ নিয়ে জনগণের মধ্যে নানা প্রশ্ন আসবে।
এদিকে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত সরকারের আমলেও সাবের গ্রেপ্তার বা আটক হননি। এক-এগারোর সরকারের সঙ্গে ‘আঁতাতের’ অভিযোগ উঠেছিল তার বিরুদ্ধে। যদিও তখন তিনি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে দলের ভেতরে-বাইরে সুপরিচিত ছিলেন। ওই সময় তিনি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সচিব ও দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন।
পরে নবম সংসদে তিনি নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলেও দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়ে। ফলে দশম ও একাদশ সংসদে তিনি এমপি হলেও দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন না। তবে একাদশ সংসদের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবেশবিষয়ক বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পান। সর্বশেষ গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ঢাকা-৯ আসনে জয়ী হয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী হন।