গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শুরু থেকেই এই সরকারে উপর নির্বাচন সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের চাপ রয়েছে। এর প্রেক্ষিতেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থার স্থায়ী রূপ দিতে কমিশন গঠন করেছে সরকার। আর প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের উপর নিয়মিত চাপ বাড়ছে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার। এমতাবস্থায়, নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা কবে আসবে তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি ভোট আয়োজন করে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থাই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। নিজেদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন নাগরিকরা। এসব নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে সবসময়ই বিতর্ক ছিল তুঙ্গে। কখনো একতরফা, কখনো রাতের ভোট এবং কখনো ডামি ভোটের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা নবায়ন করে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল। এ কাজে সহযোগী হিসেবে পাশে ছিল নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও কোনো কোনো রাজনৈতিক দল। ফলে সরকার পতনের পর নির্বাচন ব্যবস্থাকে নতুন করে সাজাতে শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ভোটাধিকার নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন দেশের ভোটাররাও। নির্বাচন কমিশন সংস্কারের পর অনুষ্ঠিত কাঙ্ক্ষিত সেই নির্বাচনে দল মত নির্বিশেষে সবার মতেরই প্রতিফলন ঘটবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তারা।
এদিকে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মনে করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। পাশাপাশি বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, এবি পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তারাও চাইছে কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন। সে লক্ষ্যে ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতিও সেরে নিচ্ছে দলগুলো। দেশের সাধারণ মানুষও মেতে উঠতে চায় নির্বাচন উপলক্ষে। সবারই টার্গেট জাতীয় নির্বাচন।
সর্বশেষ প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপেও নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করেন দলগুলোর নেতারা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারের সঙ্গে সংলাপের পর সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন আমাদের এক নম্বর প্রায়োরিটি।
সংলাপ শেষে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমাদের দেওয়া দুটি রোডম্যাপের মধ্যে একটি সংস্কারের এবং আরেকটি নির্বাচনের। আমরা আশা করছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ দৃষ্টি থেকে দেশকে ভালো জায়গায় নিয়ে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে এটাও আমরা আশা করছি যে, এ সময়টা নাতিদীর্ঘ হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত সংলাপে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেওয়া সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, আমরা একটা সরকার বদলানোর আন্দোলন করছি না, নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি না। সামগ্রিকভাবে আন্দোলন করছি যাতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়।
এই সংলাপে অংশ নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম গণমাধ্যমকে বলেন, স্বৈরাচার, খুনি, ফ্যাসিস্টরা যেন নির্বাচন করার সুযোগ না পায়, সেটা নিয়ে আমরা উপদেষ্টাদের বলেছি। দলের পক্ষ থেকে নির্বাচন সংস্কারের পাশাপাশি ভোটের আনুপাতিক হারে সংসদে প্রতিনিধিত্ব চালুর দাবি জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে, সেটার রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে।’ সংস্কার প্রস্তাবের সেই ধারাবাহিকতায় আগামী শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আবারও সংলাপে বসতে যাচ্ছে সরকার।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুতই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন সরকারের উপদেষ্টারা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের কথা বলেছেন।
এ বিষয়ে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, বিগত তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এখন সবার আকাঙ্ক্ষা একটি ভালো, উৎসবমুখর, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভেঙে পড়া রাষ্ট্র ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার দরকার। প্রয়োজনীয় সেই সংস্কারের জন্য সরকারকে খানিকটা সময় দিতে হবে। যাতে আর কোনো সরকার স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে।
আগামী নির্বাচন ও সরকারের ভাবনা সম্পর্কে সরকারের পাট ও বস্ত্র এবং নৌ পরিবহনবিষয়ক উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি সুন্দর নির্বাচন। সেই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য হতে হবে। এ নির্বাচন সঠিক না হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে না।
উল্লেখ্য, গত ৩০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাপানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম এনএইচকেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দ্রুত সংস্কারকাজ এগিয়ে নিয়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে প্রতিশ্রুতির কথা জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কারকাজ করা এবং প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে নির্বাচন আয়োজন করবে সরকার। তাদের ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই বলেও জানান প্রধান উপদেষ্টা।
অপরদিকে, নির্বাচন ছাড়াও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংস্কার চায় অন্তর্বতীকালীনন সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোরনের নেতারাও এই চায়। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তার সঙ্গে তাদের ফারাক রয়েছে। এমতাবস্থায়, আগামী শনিবার আবারও সরকার দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আহ্বান করেছেন। এখন দেখার বিষয় রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনাকে কতটা গুরুত্ব দেয় সরকার। আর রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের সংস্কারের পক্ষে তাদের চিন্তাভাবনা কি, মূলত তার উপর নির্ভর করছে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।