দেশের শেয়ার বাজারে গতকাল রোববার ‘ব্যাপক’ দরপতন হয়েছে। অধিকাংশ কোম্পানির শেয়ারদর কমায় এক দিনেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট হারিয়ে ৪৯৬৫ দশমিক ৩৯ পয়েন্টে নেমেছে, যা গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। দরপতনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে বিনিয়োগকারীরা। নজিরবিহীন এ পতনকে অস্বাভাবিক মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য গতকাল কমিটি গঠন করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
বিশ্লেষকরা বলেছেন, বাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাজারে টানা পতনে আতঙ্কিত হয়ে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রি করছেন। অন্যদিকে দরপতনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ফোর্স সেল। এতে পুঁজি হারিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। তারা বলেছেন, বর্তমানে বাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা অনেকটা নিষ্ক্রিয়। ফলে বাজার ক্রেতা সংকটে ভুগছে। এ কারণেই টানা দরপতন হচ্ছে।
গতকাল ডিএসইতে লেনদেনকৃত মোট ৩৯৪ কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৩৯টিই দর হারিয়েছে। এর মধ্যে ১৫৯টি কোম্পানির শেয়ার কমপক্ষে ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে। এতে ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স ১৪৯ দশমিক ২০ পয়েন্ট হারিয়ে ৪৯৬৫ দশমিক ৩৯ পয়েন্টে নেমে এসেছে। সূচক পতনের হার ২ দশমিক ৯১ শতাংশ। এর আগে ২০২১ সালের ৪ এপ্রিল ডিএসইএক্স সূচকটি ১৮১ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ হারিয়ে ৫০৮৯ পয়েন্টে নেমেছিল। এ হিসেবে গতকালের এ পতন সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর এ পতনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচকটি ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমে এসেছে। অন্যবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জেও (সিএসই) গতকাল সার্বিক সূচক সিএএসপিআই ২৭৪.২৯ পয়েন্ট কমে ১৪ হাজার ২৮ পয়েন্টে নেমে এসেছে।
পুঁজিবাজারের এ টানা দরপতনের জন্য গত ১৫ বছরে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিকে দায়ী করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বলেছে, অনিয়ম ও দুর্নীতি করে ‘দুর্বল’ কোম্পানিকে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করে পরে তা নিয়ে কারসাজি করে শেয়ারদর বাড়ানো হয়েছিল। কারসাজি রোধে ও পুঁজিবাজারে সুশাসন ফেরাতে বর্তমান কমিশন টাস্কফোর্স গঠন, জরিমানাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও বাজারের অবস্থা দিনদিন খারাপ হচ্ছে।
গতকাল শেয়ারবাজারে ধারাবাহিক দরপতনের প্রতিবাদে মতিঝিলস্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশন এক মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এ সময় সংগঠনটি পুঁজিবাজারে পতন রোধে ফোর্স সেল বন্ধসহ ১০টি দাবি পেশ করেন। সংগঠনের সভাপতি নূরুল ইসলাম মানিক বলেন, পুঁজিবাজারের এ মন্দাবস্থায় গেইন-ট্যাক্স দ্রুত প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়া ব্যাংক, ফাইন্যান্স, ইন্স্যুরেন্স, মিউচ্যুয়াল ফান্ড ও আইসিবিসহ পুঁজিবাজারে যেসব প্রতিষ্ঠানের যতটুকু বিনিয়োগ করার কথা তা শতভাগ কার্যকর করার দাবি জানানো হয়েছে।
বিভিন্ন অনিয়ম এবং নীতি অসংগতির কারণে দেশের পুঁজিবাজার অর্থনীতিতে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম। গতকাল এনবিআরের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খানের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি এ কথা জানিয়ে বলেন, পুঁজিবাজারে ইতিবাচক ধারা ফিরিয়ে আনতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নীতি সহায়তা প্রয়োজন।
বিএসইসির তদন্ত কমিটি গঠন :এদিকে শেয়ার বাজারের গতকালের দরপতনকে ‘অস্বাভাবিক’ মনে করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য চার সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। তদন্ত কমিটিতে রয়েছেন বিএসইসির অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ সামসুর রহমান, বিএসইসির ডেপুটি ডিরেক্টর মুহাম্মদ ওরিসুল হাসান রিফাত, ডিএসইর সহকারী মহাব্যবস্থাপক মাহফুজুর রহমান এবং সিডিবিএলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক কাজী মিনহাজ উদ্দিন।
ডিএসইএক্স সূচকের সাম্প্রতিক নিম্নমুখী প্রবণতার পিছনে কারণগুলো চিহ্নিত করা, বাজারে গুজব ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা, অন্য কোনো আনুষঙ্গিক বিষয় চিহ্নিত, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য সুপারিশ প্রদান করতে তদন্ত কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।
শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদ শেয়ার বাজারের অংশীজনদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন, বাজারের উন্নয়নে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এই টাস্কফোর্সের সুপারিশে পুঁজিবাজার সংস্কার করা হবে। সংস্কারের পথে সাময়িক অনেক সমস্যা উদ্ভূত হলেও সংস্কারের পর পুঁজি বাজারের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিশ্চিত হবে।