সাংবাদিকসহ সাধারণ মানুষকে ‘বিপদে’ ফেলার হাতিয়ার হিসেবে পরিচিত বিদ্যমান ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩’ বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। গণমাধ্যমকর্মীসহ দেশ-বিদেশের নানা মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিতর্কিত এই আইন বাতিলের প্রস্তাব শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হতে পারে। সেখানে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকারের করা সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত ধারাগুলো সংশোধন না করে পুরো আইনটি বাতিল করার। প্রয়োজনে নতুন করে আইনটি প্রণয়ন করা হবে। বিদ্যমান আইনটি বাতিল করতে এসংক্রান্ত প্রস্তাব শিগগিরই উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হবে। পরিষদের সম্মতি পাওয়া সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া শেষে আইনটি বাতিল করা হবে।
এর আগে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন অবশ্যই বাতিল হবে, আমরা সেদিকেই যাব।’ গত ৩ অক্টোবর রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩-এর প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধনী বিষয়ক এক মতবিনিময়সভায় তিনি এ কথা বলেন।
দেশের সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন।
সেই প্রতিবাদ সামাল দিতে ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম বদল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করা হয়। অনেকটা পুরনো আইনই নতুন নামে করা হয়। এটি নিয়েও ছিল অংশীজনদের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ। আইনটি প্রসঙ্গে গত ফেব্রুয়ারিতে ল রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত এক কর্মশালায় হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেছিলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইনের পাঁচটি ধারা সাংবাদিকতাকে মারাত্মক বিপদে ফেলতে পারে। এই ধারাগুলো হলো ২২, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৮।
এ ছাড়া আইনের ৪২ ধারায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। এ ধরনের নিবর্তনমূলক ধারা স্বাধীন মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা ও হুমকি।’
আইনটি নিয়ে গত ৩০ এপ্রিল এক ওয়েবিনারে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে প্রধান গবেষক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রীয়াজ, যিনি সরকার কর্তৃক গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান। তাঁর গবেষণায় বলা হয়, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এক হাজার ৪৩৬টি মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এসব মামলায় কমপক্ষে চার হাজার ৫২০ জনকে আসামি করা হয়। সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক। আর অভিযোগকারীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা শীর্ষে।
সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে ২০২১ সালে। মামলার শিকার ৪৫১ জনের মধ্যে ২০৯ জন সাংবাদিক জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত এবং ১৯৭ জন স্থানীয় সাংবাদিক। এর মধ্যে সংবাদ প্রকাশের কারণে ২৫৫ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২০২০ সাল থেকে ৪৯৫ জন রাজনীতিবিদ এবং ২৮ জন অপ্রাপ্তবয়স্কের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
তাদের মধ্যে ২২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ২১.৭৫ শতাংশ রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অর্থাৎ জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেক রাজনীতিবিদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ফেসবুক পোস্টের কারণে ৯০৮টি মামলায় মোট দুই হাজার ৩২৮ জনকে আসামি করা হয়।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলেও সাইবার নিরাপত্তা আইনে একাধিক মামলা করা হয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং সেনাপ্রধানকে উদ্দেশ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার হারিয়াছড়ি গ্রামের মোকতার হোসেনের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে একই গ্রামের মোহাম্মদ সাইফুদ্দীন মামলা করেন।
সাইবার ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামের বিচারক জহিরুল হকের আদালতে মামলাটি করা হয়। এতে তাঁর বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন ও ধর্ম অবমাননার অভিযোগও আনা হয়। মামলার আবেদন গ্রহণ করে আদালত অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) আগামী ২৭ নভেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার এবং আইসিটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইনে এখনো যে মামলাগুলো হচ্ছে, সেগুলোয় কোনো পদক্ষেপ বা কাউকে গ্রেপ্তার না করতে আইন মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। আমরা আগেই বলেছি নিবর্তনমূলক যে আইনগুলো আছে, যেগুলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাধা দেবে, সেগুলো আমরা বাতিল অথবা সংশোধন করব।’