বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্প থেকে এখনও কমিশন পাচ্ছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজিব ওয়াজেদ জয়। এমন তথ্য দিলেন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পের কারিগরি পরামর্শক কমিটির সাবেক এক সদস্য। বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে করা হয়েছে একক বিজনেস পলিসিও।
মুক্ত গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে আরোপ করতে ছাড়েনি কুখ্যাত কালাকানুন ল্যান্ডিং অ্যাক্ট।
কোন রকম পরিকল্পনা এমনকি বিজনেস মডেল, ফুটপ্রিন্ট, পর্যাপ্ত কাভারেজ এরিয়া ছাড়াই মহাকাশে পাঠানো হয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। যেন ঢাল নেই, তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার! দেশে-বিদেশে কারা গ্রাহক হবে, কী উপায়ে সেবা মিলবে, সুবিধা-ই বা কী হবে তাও যাচাই-বাছাইয়ের কোনো বালাই ছিল না।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচারের কারণে সার্কভুক্ত দেশ, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেল দেখা যায় না। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও মালয়েশিয়ার প্রবাসীরাও বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল দেখতে পাননা।
টেলিভিশন চ্যানেলের চেয়ারম্যান ও সিইও আব্দুস সালাম বলেন, “আমাদের যে দর্শকবৃন্দ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে, এরা কিন্তু আমাদের স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছেনা। তারা ইউটিউব কিংবা ফেসবুকের মাধ্যমে দেখে। এটা আমাদের জন্য ফিজিবল না।”
তাহলে কেন এই স্যাটেলাইট? এমন প্রশ্নের সদুত্তর পেতে কথা বলা হয় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রকল্পের তৎকালিন কারিগরি পরামর্শক কমিটির এই সদস্যের কাছে।
স্যাটেলাইট প্রকল্পের তৎকালিন কারিগরি পরামর্শক কমিটির সাবেক সদস্য মো. আরফে এলাহী বলেন, “ এখানে যে কাজ হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল পলিটিক্যাল ইন্টারেস্টটা। ২০১৮তে এটা যে করেই উঠাতে হবে। এটার ইনভেসটিগেশন বা স্টাডির প্রয়োজন ছিল। যদিও এটার স্টাডি শুরু হতো তাহলে ২০১৮তে এটা ঘটতো না সেটা আরও ২-৩ বছর দেরি হতো। তখন প্রেসার আসলো বেশি দেরি করা যাবে না, কারণ এরপরেই ইলেকশন ছিল।”
দলীয় স্বার্থে বাংলাদেশকে বিশ্বে ব্র্যাণ্ডিংয়ের নামে শো-অফ বা লোক দেখানোও ছিল মুখ্য। অন্তসারশূন্য স্যাটেলাইটের কারণে অবশ্য তার খেসারত দিচ্ছে বাংলাদেশ। অনৈতিক আর্থিক সুবিধা নিতে স্যাটেলাইটের মূল উদ্যোক্তা সজিব ওয়াজেদ জয় এখনও পাচ্ছেন কমিশন।
মো. আরফে এলাহী বলেন, “তৎকালীন সময়ে আমাদের আইসিটি সেক্টরের একজন এডভাইজার ছিলেন, তিনি বাইরে অবস্থান করতেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি উপদেশ দিয়েছেন। অপারেটিং কস্টের নামে বাংলাদেশি যারা বিভিন্ন সময়ে এটার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন তাদের একটা ইনসেনটিভ কোনো চ্যানেলের মাধ্যমে অন্য দেশে চলেও যেতে পারে। কেননা, বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের বিভিন্ন ঘটনা তো আমরা জানি।”
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে দেশিয় চ্যানেলগুলোকে সম্প্রচারে বাধ্য করতে ২০১৮ সালেই ল্যান্ডিং অ্যাক্ট করানো হয়। যার মাধ্যমে দেশিয় কোনও ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বিদেশি স্যাটেলাইটের গ্রাহক হতে পারবে না। ফলে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। এটিকে মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে অন্তরায় মনে করেন দেশের প্রথম টেরিস্ট্রিয়াল চ্যানেলের এই কর্ণধার।
টেলিভিশন চ্যানেলের চেয়ারম্যান ও সিইও আব্দুস সালাম বলেন, “যদি সরকার ইচ্ছে করে যে কোনো সময় এটাকে স্টপ বা ব্ল্যাক করে দিতে পারে। আমরা দেখেছি, জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সময় ইন্টারনেট বন্ধ দেওয়া হয়। তারা ইচ্ছা করলেও টিভিও বন্ধ করে দিতে পারে, সম্প্রচার হবে না। সেই কন্ট্রোলটা তার হাতে থাকার কারণেই আমি মনে করি, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের অন্তর্নিহিত কারণ।”
পূর্ণাঙ্গ সেবা পাওয়া না গেলেও কেন বেশি অর্থ আদায় করছে স্যাটেলাইট কোম্পানি! সেই প্রশ্নও তার। স্যাটেলাইট প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে হাজার কোটি টাকা যারা তছরুপ করেছে তাদের ব্যাপারে তদন্ত হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি।
টেলিভিশন চ্যানেলের চেয়ারম্যান ও সিইও বলেন, “আমি যদি অন্য একটা স্যাটেলাইটে যেতে চাই সেক্ষেত্রে তার পারমিশন নিতে হবে, সেই সঙ্গে আমাকে দ্বিগুন টাকা খরচ করতে হবে। সব টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যে চার্জ উঠতেছে তার ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া উচিত খুব শীঘ্রই এবং উন্মুক্ত করে দেওয়া উচিত। যাতে আমরা যে কোনো স্যাটেলাইটে যেতে পারি।”
স্যাটেলাইট প্রকল্পের দুর্নীতি বিষয়ে দুদকের কোনও তদন্ত-অনুসন্ধান আছে কি-না জানতে কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ চেয়েও পাওয়া যায়নি।
ল্যান্ডিং অ্যাক্টসহ সম্প্রচারে বাধ্যকরণ নীতি বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার নিতে গেলে বাঁধার মুখে পড়ে টেলিভিশন চ্যানেলটি।
গেল দুইমাস ধরে স্যাটেলাইট বিষয়ক সাক্ষাৎকারের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বনের পরেও মুখ খোলেনি বিটিআরসি। উপরন্ত চেয়ারম্যানের নিজস্ব কর্মিদের দিয়ে পদে পদে অসৌজন্যমূলক আচরণ করে ।