রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এই খবরে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে শেয়ারবাজার, শক্তিশালী হয়ে উঠেছে ডলার। এতে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির বড় প্রভাব থাকবে। আর বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজার।
পোশাকপণ্যের একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে সম্ভাবনা দেখছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে বৈশ্বিক যুদ্ধের অবসাননীতি বাণিজ্যে গতি বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ, বাণিজ্য বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা।
তাঁরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের বৈদেশিক নীতি বা বাণিজ্য নীতিতে দ্রুত তেমন পরিবর্তন হয় না। আবার ব্যবসায়ী ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক কিছুর সুবিধা বাড়বে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে ইতিবাচক ধারায় প্রভাবিত করবে। তবে ট্রাম্প অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে গুরুত্ব দেওয়া এবং বৈদেশিক কমানোর পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশের জলবায়ুসহ নানা সহায়তা কমতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ মনে করছেন, মার্কিন অর্থনীতি ও বাণিজ্যনীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এই পরিকল্পনায় থাকতে পারে ট্যাক্সছাড়, শুল্ক বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধির মতো পদক্ষেপ। এসব কারণে আগে থেকেই বৈশ্বিকভাবে বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্য প্রায় ১.৫ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে পাউন্ড, ইউরো ও ইয়েন। এ ছাড়া বিটকয়েনের দামও এক লাফে ছয় হাজার ডলার বেড়ে ৭৫,৩৭১.৬৯ ডলারে পৌঁছেছে। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড ৭৩,৭৯৭.৯৮(৳) ডলার ছিল, যা ছাড়িয়ে গেছে।
জাপানের নিক্কেই ২২৫ স্টকের সূচক ২.৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অস্ট্রেলিয়ার এএসএক্স ২০০ সূচকও ০.৮ শতাংশ বেড়েছে।
বাজার বিশ্লেষকরা মনে করেন, ট্রাম্পের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বাজারকে অস্থির করে তুলতে পারে। ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে ‘বিশ্বের ক্রিপ্টোকারেন্সির কেন্দ্র’ বানাবেন এবং সরকারি অপচয় কমাতে ইলন মাস্ককে নিয়োগ করতে চান। তা ছাড়া মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার নিয়ে নতুন সিদ্ধান্ত জানাতে পারেন।
জানতে চাইলে আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার নীতি পরিবর্তন হয় না। সরাসরি বাংলাদেশের বাণিজ্যে প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছুটা অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যমুখী। ট্রাম্প স্থানীয় বাণিজ্যে বেশি গুরুত্ব দেবেন। এর ফলে বৈদেশিক অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে সংকোচন নীতিতে চলবেন। এতে দেশটি থেকে বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ছাড় কমতে পারে। বৈশ্বিক যুদ্ধ বন্ধে সহায়ক হবে, যা বাণিজ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আবার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সীমিত সহযোগিতা থাকলে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
সৈয়দ এরশাদ বলেন, দেশের বাণিজ্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ব্যবসা সহজ করতে গুরুত্ব দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর দিতে হবে। বিশেষ করে ইউএসটিআর ও ইউটিডিএফের সঙ্গে যৌক্তিক আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রভাব বাড়াতে হবে।
অ্যামচেমের সাবেক সহসভাপতি ও মাস্টারকার্ড বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে বৈদেশিক নীতি যেহেতু খুব একটা পরিবর্তন হয় না তাই বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য যেভাবে চলছিল সেভাবেই এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশে তাদের যেহেতু এখন কমার্শিয়াল অফিস আছে তাই আমরা আশা করছি, আগামী দিনে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরো বাড়বে এবং বাণিজ্য সম্পর্ক আরো দৃঢ় হবে।’
বাণিজ্যনীতি নিয়ে ট্রাম্পের আগাম ঘোষণা : ট্রাম্পের নতুন মেয়াদে শুধু চীন নয়, বিশ্বের সব দেশেই তাঁর কঠোর বাণিজ্যনীতির আঁচ পড়তে পারে। এবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী, যে অস্ত্রটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে পারেন তা হলো শুল্ক। তিনি একাধিকবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে বেশি গুরুত্ব দেবেন। দেশটি যেসব পণ্য আমদানি করে, তার ওপর ১০ শতাংশ বা ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার পরিকল্পনা আছে। আর চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ শুল্ক হবে। ওই দেশ থেকে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে এটি ১০০ শতাংশ করার ঘোষণা আছে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে নেওয়া নীতিতে বাণিজ্য সুবিধা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এবার পাবে এমনটি আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর মোটামুটি ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এই রপ্তানির বেশির ভাগই তৈরি পোশাক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হিস্যার ৯ শতাংশ দখলে নিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে চীন আর ভিয়েতনাম।
ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় বড় ধরনের পরিবর্তন দেখছেন না বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাঁর বাণিজ্য নীতি কী হবে তার ওপর নির্ভর করবে পরিবর্তন। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ চালিয়ে যেতে তিনি যদি তাঁর ট্যারিফ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেন তাহলে বাংলাদেশের জন্য এটা ইতিবাচক হতে পারে। তবে নির্বাচনের সময়ে ট্রাম্প বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। এদিক থেকে কিছুটা অনিশ্চয়তা আছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি শাস্তিমূলক কোনো শুল্ক আরোপ না করেন, তাহলে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সুবিধা ইতিবাচক হবে।’
ট্রাম্পের বৈদেশিক সাহায্যের বিষয়ে উদার নীতি হবে বলে মনে করছেন না মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় সহায়তা কিছুটা কমতে পারে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বড় ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া টিকফা ক্ষেত্রে শ্রম ও মানবাধিকার নিয়ে রিপাবলিকান সব সময় শক্তিশালী অবস্থানে থাকে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কঠোর অবস্থানে থাকলে তাতে বাংলাদেশের শিল্পে পরিবর্তন আসবে। এসব বিষয়ের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তি খাতের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বিষয় আছে। তা দেশটির ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর করবে।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি ও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যবসায়ী। তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য ভালো হবে। বিশেষ করে তাঁর আগের মেয়াদে প্যাসিফিক চুক্তি বাতিল করেছিল। এতে সুবিধা পেয়েছে বাংলাদেশ। ওই চুক্তি হলে বাংলাদেশর জন্য চাপ তৈরি হতো। তা ছাড়া বৈশ্বিক যুদ্ধে বিশ্ববাণিজ্যে অস্থিরতা তৈরি করেছে। ট্রাম্পের নীতিতে এই যুদ্ধ অবসান হলে সরবরাহব্যবস্থা আরো ভালো হবে। ব্যবসার জন্য সুযোগ বাড়বে। যুদ্ধ থামলে বৈশ্বিক বাণিজ্য স্থিতিশীল হলে আমদানিনির্ভর পণ্যের বিরূপ প্রভাব দেশের বাজারে কমে আসবে।
বিসিআই সভাপতি বলেন, চীন বিশ্বের অন্যতম বড় রপ্তানিকারক দেশ। দেশটির ক্ষেত্রে ট্রাম্প ঘোষণা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশের বাণিজ্য সুবিধা বাড়বে।