ঢাকা
২৪শে নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
দুপুর ২:২৪
logo
প্রকাশিত : নভেম্বর ২৪, ২০২৪

পাচারের টাকায় সাম্রাজ্য: দুবাইয়ে ২০০ কোটির দুই ভিলা বিপু-কাজলের

পাচারের অর্থে বিলাসী জীবন গড়লেন দুই বন্ধু। স্বপ্নের শহর দুবাইয়ের হিলসে দুটি ডুপ্লেক্স বাড়ি কিনেছেন তারা। ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন (কাজল) পাচার করা অর্থে গড়েছেন মধ্যপ্রাচ্যে সাম্রাজ্য। শুধু বিলাসবহুল বাড়ি নয়, অবৈধভাবে নানা ব্যবসায় রয়েছে বিনিয়োগ।

দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে বিত্ত-বৈভবের নেপথ্যে রয়েছে কমিশন বাণিজ্য এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে আত্মসাৎ করা অর্থ পাচার।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অর্থপাচারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অন্যতম মুখ্য ভূমিকায় সম্পৃক্ততার সমালোচনা রয়েছে এই দুই বন্ধুর বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ আমলে দীর্ঘ ১১ বছর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন নসরুল হামিদ বিপু।

প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে বিপুর সব কমিশন বাণিজ্যের টাকা নিতেন কাজল। কমিশনের এই টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করেন তিনি। একই সঙ্গে পিপলস লিজিংয়ের কয়েক শ কোটি টাকা শামসুল আলামিন গ্রুপের মালিক আলমগীর শামসুল আলামিন কাজল পাচার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এসব পাচারকৃত অর্থে দুবাইয়ে বিলাসবহুল বাড়ি ক্রয় ছাড়াও ব্যাংককের সুখুমভিট এলাকায় একটি হোটেলেও ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন কাজল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা-বাণিজ্য রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশে। অভিযোগ আছে, বিদ্যুৎ খাত থেকে হরিলুট করে এই বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করেছেন তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ খাতে হরিলুটের অন্যতম উৎস ছিল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। তখন বিনা টেন্ডারে প্রয়োজনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেওয়া হয়।

এসব উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে চুক্তি অনুযায়ী বছরের পর বছর সরকারকে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অনুসন্ধানে নেমেছেন দুদকের কর্মকর্তারা। আবার বিপু, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিপু ও তার সঙ্গে দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত থাকা পরিবারের লোকজন এবং সহযোগীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে।

দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে কম্পানি খুলে সেই কম্পানির মাধ্যমে নসরুল হামিদ বিপু হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন। এই কম্পানি প্রতিষ্ঠাকালে নসরুল হামিদ তার নিজের যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অবস্থিত বাসভবনের ঠিকানা ব্যবহার করেন। পাঁচ বেডরুমের এই বাসভবনের বাজারমূল্য ৩৬ লাখ ১৭ হাজার ৪১৫ মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশি টাকায় এর মূল্য ৪২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। যুক্তরাষ্ট্রে শরীফ হায়দার নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে নসরুল হামিদ তার স্ত্রী সীমা হামিদকে নিয়ে ‘পথ ফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল’ নামে একটি ট্রেড করপোরেশনের লাইসেন্স নেন। এই করপোরেশনের আওতায় মোবিল গ্যাস স্টেশনসহ দেড় ডজনের মতো ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

ফ্লোরিডায় অবস্থিত ওই গ্যাস স্টেশনটি কেনা হয় কয়েক মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে। আর শরীফ হায়দারের মাধ্যমেই হাজার কোটি টাকা যুক্তরাষ্ট্রে পাচার করেন নসরুল হামিদ। দায়িত্বে থাকাকালেই নসরুল হামিদ ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে দেশের বৃহত্তম এলপিজি টার্মিনাল নির্মাণের কাজে জাল-জালিয়াতি ও দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্যও মিলেছে।

বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে চার কোটির বেশি গ্রাহককে প্রি-পেইড মিটার দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। একে একে ছয়টি বিতরণ সংস্থা মিটার আমদানি করতে থাকে। এ নিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। আর এই বাণিজ্যের পুরোটার নিয়ন্ত্রণ নেয় সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর ‘ভাই-বন্ধু’চক্র। এই চক্রে বিপুর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন শামসুল আলামিন কাজল। মিটার বাণিজ্যের নামে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ আছে এই চক্রের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, প্রি-পেইড মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে। মিটার সরবরাহ বাড়তে থাকে ২০২০ সালের পর। চীনের তিনটি কম্পানি একটি চক্রে যুক্ত হয়ে সব মিটার সরবরাহ করে।

মিটার উৎপাদন করে দরপত্র ছাড়াই সরাসরি সরবরাহের জন্য দুটি নতুন সরকারি কম্পানি তৈরি করা হয় নসরুল হামিদের নির্দেশে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কম্পানি লিমিটেড (বেসিকো)। বিতরণ খাতের ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি (ওজোপাডিকো) ৫১ শতাংশ ও চীনের হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কম্পানি লিমিটেড ৪৯ শতাংশ শেয়ার নিয়ে বেসিকোর নিবন্ধন নেয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। হেক্সিংয়ের স্থানীয় প্রতিনিধি হলেন শামসুল আলামিন কাজল।

বাংলাদেশ পাওয়ার ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি লিমিটেড (বিপিইএমসি) নামে আরো একটি কম্পানি তৈরি করা হয় স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার তৈরির জন্য। রুরাল পাওয়ার কম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ৫১ শতাংশ শেয়ার ও চীনের সেনজেন স্টার ইনস্ট্রুমেন্ট কম্পানি লিমিটেড ৪৯ শতাংশ শেয়ার নিয়ে এটি নিবন্ধিত হয়। সেনজেন স্টারের স্থানীয় প্রতিনিধি নসরুল হামিদের আত্মীয় মাহবুব রহমান ওরফে তরুণ। এভাবেই নসরুল হামিদের ‘ভাই-বন্ধু’চক্র দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা হতো বিদ্যুৎ খাত।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, নিম্নমানের মিটার দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। মিটার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত সচিব, ব্যবসায়ীসহ সবার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে, ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে।

পিপলস লিজিং লুটপাটের কারিগরদের মধ্যে একজন শামসুল আলামিন গ্রুপের মালিক শামসুল আলামিন কাজল। জানা গেছে, ক্যাপ্টেন মোয়াজ্জেম পিপলস লিজিংয়ের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় সংঘটিত অনিয়মে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৮৪০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরোক্ষভাবে এসব অর্থের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী ছিলেন শামসুল আলামিন গ্রুপ।

হাইকোর্টে পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, লুটপাট হওয়া দুই হাজার ১৭৫ কোটি টাকার মধ্যে পিপলস লিজিং থেকে ৩৩৫ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিয়েছিল শামসুল আলামিন গ্রুপ। এর মধ্যে ১৯১ কোটি টাকা সরাসরি লোন ও বাকি ১৪৪ কোটি টাকা মার্জিন লোন। এসব ঋণের বেশির ভাগ অর্থ পরিশোধ করে দেওয়ার দাবি শামসুল আলামিনের।

সূত্র জানায়, মূল ঋণের বেশির ভাগ অর্থই পরিশোধ করা হয়নি। এ ছাড়া আইন অনুযায়ী, একই প্রতিষ্ঠানের বোর্ড সদস্যের সুদ মওকুফ করার কোনো সুযোগ নেই। আর সে সময় শামসুল আলামিন ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক।

হাইকোর্টের নির্দেশে একনাবিন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টকে প্রতিষ্ঠানটি অডিট করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। একনাবিনের অডিট রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ২১ জুলাই পর্যন্ত পিপলস লিজিংয়ের কাছে শামসুল আলামিন গ্রুপের দায় ছিল ৩৩৫ কোটি টাকা।

এসব অভিযোগের বিষয়ে সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং শামসুল আলামিন কাজনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তারা আত্মগোপনে আছেন।

logo
প্রকাশকঃ অধ্যাপক ড. জোবায়ের আলম
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ তাপস রায় সরকার
মোবাইল: +৮৮০ ১৭৩৬ ৭৮৬৯১৫
কার্যালয় : বিটিটিসি বিল্ডিং (লেভেল:০৩), ২৭০/বি, তেজগাঁও (আই/এ), ঢাকা-১২০৮
মোবাইল: +880 2-8878026, +880 1736 786915, +880 1300 126 624
ইমেইল: tbtbangla@gmail.com (online), ads@thebangladeshtoday.com (adv) newsbangla@thebangladeshtoday.com (Print)
বাংলাদেশ টুডে কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত। অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি ও বিষয়বস্তু অন্য কোথাও প্রকাশ করা বে-আইনী।
Copyright © 2024 The Bangladesh Today. All Rights Reserved.
Host by
linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram