ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ইসলামী ব্যাংক দখলমুক্ত হলেও ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী পদে কোনো পরিবর্তন আসেনি। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা এখনো আছেন বহাল তবিয়তে। ২০১৭ সালে ব্যাংকটি দখলের পর বিভিন্ন সময়ে ৪৫টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৮৮ হাজার কোটি টাকা বের করে নেয় এস আলম গ্রুপ। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সম্মতি ছাড়া এ পরিমাণ অর্থ বের করা কোনোভাবেই সম্ভব না বলে মনে করেন ব্যাংকিং খাতের অভিজ্ঞরা।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয় এস আলম গ্রুপ। ঋণের নামে জনগণের আমানত বের করে নেওয়ার পাশাপাশি বিদেশে পাচার সবকিছুই হয়েছে ব্যাংকের এমডি মুনিরুল মওলার সম্মতিতে। সব ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ব্যাংকিং নিয়মনীতি উপেক্ষা করে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংককে এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যদিও তা পুরোপুরি হয়নি।
উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আকিজ উদ্দিন চৌধুরী, মিফতাহ উদ্দিন আহমেদসহ কয়েকজনকে বরখাস্ত করলেও ঋণের নামে ব্যাংক থেকে অর্থ বের করতে সহায়তাকারী এমডি, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি), সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্টসহ বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এখনো বহাল রয়েছেন।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে ৪৫টি অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে এস আলম গ্রুপ ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ৮৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। গত সাত বছরে নামে-বেনামে ব্যাংকটির বিতরণ করা ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঋণের ৮২ শতাংশই নিয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রুপটি। আর নিয়মবহির্ভূত এসব ঋণ বিতরণে প্রধান সহযোগীর ভূমিকায় ছিলেন ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা।
২০২১ সালের ১ জানুয়ারি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তার হাত ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার বেপরোয়া ঋণ বিতরণ করা হয় এস আলম গ্রুপের নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মধ্যে ২৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে এস আলমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর নামে এবং বাকি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে দেশবন্ধু গ্রুপ, ইউনিটেক্স গ্রুপ, অ্যানানটেক্স গ্রুপসহ ২৯টি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে।
জানা গেছে, ২০২২ সালের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর নাবিল গ্রুপকে ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক। নাবিল গ্রুপকে ঋণ বিতরণকারী শাখার কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, প্রধান কার্যালয় বিশেষ করে এমডির নির্দেশেই অর্থ ছাড় করা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, ঋণের টাকা ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা আছে কি না, ঋণ কেন প্রয়োজন এসব কিছুই যাচাই না করে চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংকের চাক্তাই শাখায় অ্যাকাউন্ট খোলার এক মাসের মধ্যে ঢেউটিন বিক্রির প্রতিষ্ঠান মুরাদ এন্টারপ্রাইজকে ৮৯০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়।
এক বছর পর কম্পানিটিকে আরও ১১০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নথি অনুযায়ী, এ মুরাদ এন্টারপ্রাইজ এস আলম গ্রুপের একটি ছায়া কম্পানি। ইসলামী ব্যাংক মুরাদ এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে খুবই কম পরিমাণ জামানত নিয়েছে। নথি অনুযায়ী, ১০টি কম্পানির মাধ্যমে এ শাখা থেকে ৩৫ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে। এস আলম গ্রুপ এবং এর ছায়া কম্পানিগুলো নাবিল ফুডস, নাবিল অটো রাইস মিলস, এম এস এ জে ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, আনোয়ারা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা থেকে ২৯ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট এবং অন্যান্য শাখা থেকে নিয়ম লঙ্ঘন করে আরও ২৩ হাজার ৯০০ কোটি টাকা নিয়েছে ব্যবসায়িক গ্রুপটি।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে ইসলামী ব্যাংকের ঋণ বিতরণে অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে তথ্য এলেও ব্যাংকটির এমডি মুনিরুল মওলা সব সময় তা অস্বীকার করেছেন। সে সময় তিনি গণমাধ্যমে বলেন, ‘ঋণ বা বিনিয়োগের জন্য সর্বোচ্চ পোর্টফোলিও ধারণ করা হয়। সুতরাং এ ধরনের একটি ব্যাংক, যারা ৪০ বছর ধরে কার্যক্রম চালাচ্ছে তাদের এ ধরনের অনিয়ম করার কোনো সুযোগ নেই। সিস্টেম আছে, এ সিস্টেমের ভেতরে আমাদের সবকিছু হয়। এখানে বেনামি ঋণ বলে কিছু নেই, নামেই আছে।’
নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে, তা খেলাপি হওয়ার আশঙ্কা নেই। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হয়েও যায় তাদের অর্থ জামানত থেকে উঠে আসবে।’ অথচ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর একে একে ব্যাংকটির দুরবস্থার চিত্র বেরিয়ে এসেছে। নামে-বেনামে ঋণ দেওয়ার কারণে তীব্র তারল্য সংকটে ভুগছে ইসলামী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সিআরআর ও এসএলআর রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছে। আবার চলতি হিসাবেও ঘাটতি ছিল, এতদিন যা লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এত কিছুর পরও সেই এমডি এখনো কীভাবে ইসলামী ব্যাংকে বহাল আছেন? তা নিয়ে ব্যাংকিং খাতে নানামুখী আলোচনা চলছে। এমডি ছাড়াও এসব ঋণ বিতরণে অনিয়মে জড়িতদের মধ্যে এখনো বহাল রয়েছেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলতাফ হুসাইন, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (এসইভিপি) জি এম মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন কাদের, এসইভিপি ও আইটিপ্রধান আহমেদ জুবায়েরুল হক, অডিটপ্রধান মো. রাজা মিয়া, এমডি সেক্রেটারিয়েট খালেদ মাহমুদ রায়হান ও এ এম শহিদুল এমরান, সার্ভিস উইংয়ের প্রধান এহসানুল হক, এসভিপি মো. সোহেল আমান, প্রধান বিপণন বিশেষজ্ঞ গান্ধী কুমার রায়, মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী, আবদুল মান্নান, মোস্তাক আহমেদ।
মানবসম্পদ বিভাগের মো. মোস্তফা, মো. জাহেদুল ইসলাম ও মো. আবদুল্লাহ খালেদ। এ ছাড়া এভিপি আমিন উল্লাহ পাশা, মো. তাহেরুল আমিন ও মো. খালেদ মোর্শেদ। প্রধান কার্যলয় ছাড়াও বিভিন্ন শাখায় ঋণ বিতরণে অনিয়মে জড়িতদের মধ্যে চট্টগ্রামের জোনপ্রধান মিয়া মো. বরকত উল্লাহ, উত্তরের জোনপ্রধান নুরুল হোসেন কাওসার, আগ্রাবাদ শাখাপ্রধান আবদুল নাসের, রাজশাহীর সাবেক জোনপ্রধান মো. মিজানুর রহমান, রাজশাহী নিউমার্কেট শাখাপ্রধান মুন্সি রেজাউর রশিদ, গুলশান করপোরেট শাখাপ্রধান এ টি এম শহিদুল হক, রাজশাহী শাখাপ্রধান ওয়াসিউর রেজা, খাতুনগঞ্জ শাখাপ্রধান সিরাজুল ইসলাম কবির, নিজাম রোড শাখাপ্রধান মো. আসিফুল হক, জুবলী রোড শাখাপ্রধান মো. শাহাদাত হোসেন, পাবনা শাখাপ্রধান মো. শাহজাহান এবং চাক্তাই শাখাপ্রধান মনজুর হাসান।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ইসলামী ব্যাংকের এমডি মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, ‘ব্যাংকের টাকা ভিন্ন খাতে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নিচের দিকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তবে দুষ্ট কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’