ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে বিসিএসের ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদের ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন গ্রেপ্তার ১৭ জনের মধ্যে সাতজন। পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ জবানবন্দি দেওয়া সাত আসামি দিয়েছেন চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বেরিয়ে এসেছে প্রশ্নফাঁসের আরেক মাস্টারমাইন্ডের নাম।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় নোমান সিদ্দিক ও আবেদ আলীসহ গ্রেপ্তার ১৭ আসামিকে মঙ্গলবার (০৯ জুলাই) কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। তাদের মধ্যে সাতজন আদালতে জবানবন্দিতে দোষ স্বীকার করেছেন। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
জবানবন্দি দিয়ে কারাগারে যাওয়া আসামিরা হলেন— সৈয়দ আবেদ আলী, মো. খলিলুর রহমান, সাজেদুল ইসলাম, ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থী বর্তমানে মিরপুরের ব্যবসায়ী আবু সোলেমান মো. সোহেল, মো. সাখাওয়াত হোসেন, সায়েম হোসেন ও বেকার যুবক লিটন সরকার।
কারাগারে যাওয়া অন্য আসামিরা হলেন— পিএসসির উপ-পরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাবেক সদস্য নোমান সিদ্দিকী, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ব্যবসায়ী মো. জাহিদুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশীদ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিক্যাল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান ও আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। এর আগে ৩১ জনের নাম উল্লেখ করে সরকারি কর্ম কমিশন আইনে ডিএমপির পল্টন থানায় মামলা দায়ের করে সিআইডি।
সংশ্লিষ্ট আদালত সূত্র জানায়, লক্ষ্মীপুরের রামগতি থানার চরআলগী গ্রামের মো. আবু তাহেরের ছেলে মো. নোমান সিদ্দিক এক সময় একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি করতেন। ২০০৪ সালে পিএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন চাকরির তদবির করতেন। তখন এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয় অর্থ বিভাগের অডিটর প্রিয়নাথ রায়ের সঙ্গে। প্রশ্নপত্র বিক্রি করে নোমান ঢাকার পাশেই একটি তৈরি পোশাক কারখানা দিয়েছেন। থাকেন মিরপুর ১০ নম্বরের সেনপাড়া পর্বতার ৪৫৮/৪ নম্বর ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটের মালিক তিনি নিজেই।
অন্যদিকে, জিজ্ঞাসাবাদে প্রিয়নাথ রায় বলেছেন, যখন তিনি নোমান সিদ্দিকের সঙ্গে পরিচিত হন, তখন নোমান একটি বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। ২০১৫ সালে দুজনকে মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পাইয়ে দিতে নোমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তাদের মধ্যে একজন ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হন। এরপর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নিয়োগে ভাইভার তদবির করেন। নোমান সিদ্দিক বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের প্রশ্নও ফাঁস করেছেন কয়েক বছর ধরে। এই নোমান প্রশ্ন ফাঁসের আরেক মাস্টারমাইন্ড।
গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মো. সাখাওয়াত হোসেন তার জবানবন্দিতে বলেছেন, ৮ম শ্রেণি পাস করা পানির ফিল্টারের ব্যবসায়ী সাখাওয়াতের পাসপোর্টে কানাডা ও ইংল্যান্ডের ভিসা রয়েছে। সাখাওয়াত জানিয়েছেন, টুরিস্ট ভিসায় কানাডা ঘুরে এসেছেন একবার। ইংল্যান্ডের ভিসা পেলেও যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। দ্রুতই স্থায়ীভাবে কানাডা থিতু হতে চেয়েছিলেন। পল্টনের কালভার্ট রোডের ১৪১/২ নম্বর বাড়ির ২য় তলায় তার পানির ফিল্টারের গুদাম রয়েছে। ব্যবসায় সহযোগিতা করেন তারই আপন ভাই সিদ্ধেশ্বরী কলেজের ছাত্র সায়েম হোসেন। পিএসসির অফিস সহায়ক মো. সাজেদুল ইসলাম তার বন্ধু। এই সূত্রে দামি গাড়ি নিয়ে সাজেদুল প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা করে চাকরিপ্রত্যাশী কেউ থাকলে জানাতে বলে। সাজেদুলের আফতাবনগরে নিজের ফ্ল্যাট রয়েছে। সবশেষ শুক্রবার (০৫ জুলাই) অনুষ্ঠিত রেলওয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী নিয়োগ পরীক্ষার ৪৬ জন প্রার্থীকে তার ওই গুদামে রাখা হয়। রাতভর চাকরি প্রার্থীরা ফাঁস হওয়া প্রশ্ন মুখস্ত করে পরের দিন পরীক্ষা দিতে যান।
সাখাওয়াতের ভাই সায়েম তদন্তকারী সংস্থা সিআইডিকে জানিয়েছেন, সাজেদুল তাকে ফোন করে পল্টন থেকে দুই জন চাকরিপ্রত্যাশীকে রিসিভ করে গুদামে নিয়ে রাখতে বলে। তখন সে তাদের আনতে গেলে দেখে একটি মাইক্রো থেকে ৮ জন চাকরিপ্রত্যাশী নেমেছে। এভাবে ধাপে ধাপে ৪৬ জন চাকরিপ্রত্যাশীকে গুদামে নিয়ে যান তিনি।
ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার লিটন সরকার জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার জাহিদুল বৃহস্পতিবার দুজন চাকরিপ্রত্যাশীকে শ্যামলী থেকে রিসিভ করতে বলেন। এরপর গভীর রাত হলেও জাহিদ কোনো যোগাযোগ করছিল না। একপর্যায়ে তাদেরকে একটি আবাসিক হোটেলে রাখতে বলে। পরে জাহিদ এসে ওই চাকরিপ্রত্যাশীদের সঙ্গে দেখা করে।
প্রসঙ্গত, সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে সোমবার (০৮ জুলাই) পিএসসির দুই জন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী এবং তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম ফেসবুকে ভাইরাল হন। তাদের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলায়।