বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) প্রশ্নফাঁস নিয়ে বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল। গত একযুগে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর এসব ফাঁস করা প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন অনেকেই। তাদের অনেকে এখন বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরিও করছেন। যারা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে চাকরি করছেন প্রশ্নফাঁস-কাণ্ডে একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসার পর তারাও রয়েছেন আতঙ্কে।
সূত্রের তথ্যে জানা গেছে, ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ১০ জন প্রার্থীর কাছে প্রশ্নফাঁস করে একটি চক্র। তাদের মধ্যে তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন। এছাড়া আরও কিছু ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে আলোচনায়।
বিপিএসসির প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) করা মামলায় গতকাল মঙ্গলবার পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীসহ ছয়জন দায় স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন।
৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ১০ জন প্রার্থীর কাছে প্রশ্নফাঁস করেন খলিল। এর মধ্যে তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন। ওই বিসিএসে তার ফাঁস করা প্রশ্নে ১০ জনের মধ্যে ছয়জন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সেই ছয়জনের মধ্যে তিনজন মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়েন।- আদালতে খলিলুরের জবানবন্দি
দায় স্বীকার করা অন্য আসামিরা হলেন- পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক (ডিসপাস) সাজেদুল ইসলাম, ব্যবসায়ী সহোদর সাখাওয়াত হোসেন ও সায়েম হোসেন এবং বেকার যুবক লিটন সরকার।
জবানবন্দি দেওয়া ছয়জনের মধ্যে পিএসসির অফিস সহায়ক খলিলুর রহমান বলেছেন, ৩৩তম বিসিএস পরীক্ষায় ১০ জন প্রার্থীর কাছে প্রশ্নফাঁস করেছেন তিনি। এর মধ্যে তিনজন বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করছেন। ওই বিসিএসে তার ফাঁস করা প্রশ্নে ১০ জনের মধ্যে ছয়জন লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন। সেই ছয়জনের মধ্যে তিনজন মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়েন।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় অভিযুক্ত খলিলুর রহমান ঢাকার একটি মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানান।
তার তথ্যগুলো এখন তদন্ত করছে সিআইডি। তদন্তে যদি তার ফাঁস করা প্রশ্নে সত্যিই ওই তিনজন কর্মকর্তার বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি করার সত্যতা মেলে তবে তাদের বিষয়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবে সিআইডি।
এছাড়াও, সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও রেলের অন্তত কয়েকশ নিয়োগে খলিলুরের হাত ছিল বলেও তিনি আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
আটকের পর রাজধানীর মিরপুরে খলিলের বাসায় গিয়ে তার বিলাসী জীবনযাপন দেখে চমকে উঠেছিলেন খোদ সিআইডি কর্মকর্তারাও। অর্থাৎ, খলিল প্রশ্নফাঁস করে দ্রুতই বনে গেছেন কোটিপতি।
জবানবন্দিতে খলিলুর আরও জানিয়েছেন, পিএসসির সাবেক একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে তিনি চাকরিপ্রার্থীদের পরিচয় করিয়ে দিতেন। সেখান থেকে সবুজ সংকেত মিললে নিয়োগের বিষয়ে আর্থিক লেনদেনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতো।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়ামুলও এসব প্রশ্নপত্র ফাঁসে বিভিন্ন সময় তাকে সহযোগিতা করেছেন বলে জানিয়েছেন খলিলুর। তার বিরুদ্ধে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অপরাধে ফৌজদারি ও বিভাগীয় মামলা হলেও অভিযোগ থেকে নাম কাটিয়ে আদালতের আদেশ নিয়ে আবার ফেরেন পিএসসিতে।
২০১২ সালে ৩৩তম বিসিএসের সময় কর্মচারী খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে ঢাকার শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়। সে সময় তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করে র্যাব। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন। একই সময় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলাও হয়।
পিএসসির একজন কর্মকর্তা বলেন, অনেক দৌড়ঝাঁপ করে খলিলুর মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে সফল হন। পরে ২০২২ সালের মার্চে মামলা ও বিভাগীয় মামলায় যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়।
টানা ১০ বছর সাময়িক বরখাস্তের সময়ে তিনি বকেয়া বেতন-ভাতাও ফেরত পান। বর্তমানে তিনি ডেসপাস রাইডার পদে কর্মরত।
বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
বিসিএসসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে পিএসসির ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ১৭ জনের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।- বিএফআইইউ
বিএফআইইউ সূত্র জানায়, ব্যাংক হিসাব জব্দ সংক্রান্ত চিঠি বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর কাছে পাঠানো হয়েছে। এ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত সেসব হিসাব জব্দ থাকবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিএফআইইউয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) গ্রেফতার হওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এরই মধ্যে তাদের গ্রেফতার করেছে সিআইডি। বিসিএসসহ ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
পিএসসির সাবেক সহকারী পরিচালক নিখিল চন্দ্র রায়, শরীফুল ইসলাম ভূঁইয়া, দীপক বণিক, খোরশেদ আলম খোকন, কাজী মো. সুমন, এ কে এম গোলাম পারভেজ, মেহেদী হাসান খান, গোলাম হামিদুর রহমান, মুহা. মিজানুর রহমান, আতিকুল ইসলাম, এটিএম মোস্তফা, মাহফুজ কালু, আসলাম ও কৌশিক দেবনাথ।
সিআইডি জানায়, গত ৫ জুলাই পিএসসি আয়োজিত রেলওয়ের সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারের (নন-ক্যাডার) নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন হুবহু ফাঁস হয়েছে। পরীক্ষা শুরুর নির্ধারিত সময়ের আগে অর্থের বিনিময়ে চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্ন এবং উত্তর সরবরাহ করে সংঘবদ্ধ চক্র।
কারাগারে পাঠানো ১০ আসামি হলেন- পিএসসি চেয়ারম্যানের সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলীর ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান ওরফে সিয়াম, পিএসসির উপপরিচালক মো. আবু জাফর ও মো. জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক মো. আলমগীর কবির, সাবেক সেনাসদস্য নোমান সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ঢাকার ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অফিসে কর্মরত মো. মামুনুর রশিদ, নারায়ণগঞ্জ পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদত হোসেন, এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিকেল টেকনিশিয়ান মো. নিয়ামুন হাসান এবং মো. জাহিদুল ইসলাম।
প্রশ্নফাঁসে গ্রেফতার পিএসসির উপপরিচালক আবু জাফর ও জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির এবং পিএসসির কর্মচারী (ডেসপাস রাইডার) খলিলুর রহমান ও অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলামকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে পিএসসি।
পিএসসির চেয়ারম্যানের সই করা বহিষ্কার আদেশে দেখা গেছে, ওই পাঁচজনকে চাকরি আইন অনুসারে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।