ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান এবং তার পরিবারের বিপুল সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। দ্বিতীয় দফায় তাদের যেসব সম্পদ ক্রোক করার আদেশ দেওয়া হয়েছে তার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৫৪০ শতাংশ জমি রয়েছে তার প্রথম স্ত্রীর ছেলে অর্ণবের নামে। যদিও অর্ণবের কোনো চাকরি বা উল্লেখযোগ্য ব্যবসা নেই।
এদিকে বহুল আলোচিত এ রাজস্ব কর্মকর্তাকে এখনো প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। তিনি এনবিআর থেকে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত হয়ে কর্মস্থলে যোগদান করলেও অফিস করছেন না। আবার তিনি ছুটিও নেননি। তবে সূত্র জানিয়েছে, তিনি দেশেই, অনেকটা আত্মগোপনে আছেন।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ জুলাই ঢাকা মহানগর জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন তাদের যেসব সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেন তার মধ্যে রয়েছে- ২ হাজার ৩৫১ শতাংশ জমি, মিরপুরে চারটি ফ্ল্যাট এবং ১১৬টি ব্যাংক হিসাবে রক্ষিত ১৩ কোটি ৪৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৭১ টাকা। এছাড়া ২৩টি বিও অ্যাকাউন্টও অবরুদ্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ক্রোক ও অবরুদ্ধ সম্পদের তালিকায় মতিউর রহমান, তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ এবং তাদের মেয়ে ফারজানা রহমান ও ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব এবং দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আক্তারের সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব রয়েছে।
যেসব জমি ও ফ্ল্যাট ক্রোকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে- তার মধ্যে রয়েছে ঢাকার সাভারে ১৬ শতাংশ, ময়মনসিংহের ভালুকায় ১০৬২ শতাংশ, গাজীপুরে ৮৭৫.৯৫ শতাংশ, নরসিংদীর শিবপুরে ২৩৬ শতাংশ, নাটোরের সিংড়ায় ১৬৬ শতাংশ জমি ও মিরপুরে চারটি ফ্ল্যাট।
এর আগে প্রথম দফায় গত ৪ জুলাই মতিউর ও তার প্রথম স্ত্রীর ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান, মেয়ে ফারজানা রহমান এবং দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আক্তারের নামে থাকা ৮৬৬ শতক জমি জব্দের আদেশ দেন একই আদালত। পাশাপাশি বসুন্ধরা ও ধানমন্ডিতে প্রথম স্ত্রীর মেয়ে ফারজানা রহমান, দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আক্তার ও প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে থাকা চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় দফা ক্রোকের নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এসব জমির মধ্যে ৫৪০ শতাংশ জমি অর্ণবের নামে কেনা। মতিউরের প্রথম স্ত্রীর প্রথম সন্তান বড় কোনো চাকরি বা উল্লেখযোগ্য ব্যবসা না করলেও তার নামে এত সম্পদ প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এছাড়া তার তিনটি বিও অ্যাকাউন্ট ও প্রায় দুই ডজন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।
জানা যায়, ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার হবিরবাড়ি ইউনিয়নের ঝালপাজা মৌজায় গ্লোবাল সুজ লিমিটেড নামে বিশাল একটি জুতার কারখানা রয়েছে। যেখানে কাজ করেন দেশি-বিদেশি শতাধিক কর্মী। প্রায় ১ হাজার ৬২ শতাংশ জমির ওপর এই জুতার কারখানা ছাড়াও বাগানবাড়ি, বিভিন্ন ফলের বাগান ও পতিত জমি রয়েছে। এসব জমির মালিক মতিউর পুত্র অর্ণব ও মতিউরের ভাই এম এ কাইউম।
সাভারে প্রায় ২৬ শতাংশ জমির মালিক মতিউর ও তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ। এছাড়া গাজীপুরের খিলগাঁও ও পুবাইল মৌজায় আপন ভুবন শুটিং স্পট ও পুবাইলে মতিউর, তার প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের নামে রয়েছে ৮৭৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ জমি।
নরসিংদীর শিবপুরে লায়লা কানিজের নামে ৩৮ শতাংশ, অর্ণবের নামে ১২৬ শতাংশ ও ফারজানার নামে রয়েছে ৭২ শতাংশ জমি। নাটোরের সিংড়ায় লায়লা কানিজের নামে ১৬৬ শতাংশ ও মিরপুরের মাজার রোডে চারটি ফ্ল্যাট।
কোরবানি ঈদের আগে মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাতের লাখ টাকার ছাগল কেনার ছবি ও ভিডিও সামনে এলে আত্মগোপনে চলে যান মতিউর। জুনের শেষ সপ্তাহে তাকে এনবিআরের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। নতুন কর্মস্থলে তিনি লোক পাঠিয়ে যোগদান করলেও নিজে এখনো অফিস করেননি। এমনকি ছুটিও নেননি তিনি। এ অবস্থায় মতিউর বিদেশে পালিয়েছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
তবে দুদক সূত্রে জানা গেছে, দেশেই আছেন এই কর্মকর্তা। গত ৪ জুলাই সম্পদের হিসাব চেয়ে দুদকের পাঠানো নোটিশ তিনি নিজে স্বাক্ষর করে গ্রহণ করেছেন। একই দিন তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ, প্রথম পক্ষের ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও মেয়ে ফারজানা রহমান ঈপ্সিতার পক্ষে স্বাক্ষর করে সম্পদের নোটিশও গ্রহণ করেন এই কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা বলেন, মতিউর দেশেই আছেন। সম্পদের নোটিশ গ্রহণ করেছেন। তবে তিনি বেশিদিন এক ঠিকানায় থাকছেন না। এক ধরনের আত্মগোপনে রয়েছেন তিনি।
জানা গেছে, মতিউর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদের হিসাব চেয়ে দুদক তাদের বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানায় চিঠি পাঠায় গত ২ জুলাই। সেদিন দুদকের বিশেষ বাহক মতিউরের বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসায় গিয়ে তাকে পাননি। তিনি বাসার নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, মতিউর বাসায় নেই। নিরাপত্তারক্ষী মতিউরের সঙ্গে কথা বলে জানাবেন বলে দুদকের বাহককে জানান। পরে ওই নিরাপত্তাকর্মী দুদকের প্রতিনিধিকে জানান, ৪ জুলাই মতিউর বাসায় থাকবেন। ওই দিন নোটিশগুলো নিয়ে যেতে বলেন।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে দুদকের বাহক মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলীর ধানমন্ডির বাসায় গিয়ে দেখেন বাসাটি তালাবদ্ধ। তার অবস্থানের ব্যাপারে কথা বলার জন্য কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে দুদক কর্মকর্তারা তার বাসার সামনে নোটিশটি টানিয়ে দেন।
তবে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলী ও তার তিন ছেলেমেয়ে বিদেশে পালিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা ওই কর্মকর্তার।
দুদকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, পরিবারের সদস্যদের তথ্য ও অবস্থান জানতে পাসপোর্ট অফিসে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সম্পদের তথ্য চেয়ে দুদকের নোটিশটি মতিউরের বসুন্ধরার বাসা ছাড়াও বরিশালের মুলাদীতে স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। একইভাবে মতিউরের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের বসুন্ধরার বাসা ও নরসিংদীর রায়পুরার স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবলীর নোটিশ ধানমন্ডির বাসা ছাড়াও ফেনীতে তার স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে।
দেশের পাশাপাশি বিদেশে সম্পদ গড়েছেন মতিউর। দুবাই, কানাডায় গড়েছেন এসব সম্পদ। সেসব সম্পদের হদিস জানতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটে (বিএফআইইউ) চিঠি দিয়েছে দুদক। দুদকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, যেসব সম্পদের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে তারচেয়েও বেশি সম্পদ আছে মতিউরের। যেই সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম থেকে ছাগলকাণ্ডের শুরু, সেখানেও তার বিনিয়োগ থাকার তথ্য প্রমাণ পেয়েছে দুদক।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সাদিক অ্যাগ্রোতে মতিউরের বিনিয়োগ আছে। সেটা কত, আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। এছাড়া মতিউরের আর কোথায় কোথায় বিনিয়োগ আছে তা খুঁজতে সিকিউরিটি একচেঞ্জ কমিশন ও আরজিএসসিতে পাঠানো হয়েছে চিঠি।
আলোচিত ছাগলকাণ্ডের পর বারবার মোবাইল নম্বর পরিবর্তন করায় মতিউরের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন বলেন, মো. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকের টিম কাজ শুরু করেছে। বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য চেয়ে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা যাচ্ছে না।