সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে নিহত সবার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান এখনো জানা যায়নি। তবে গত কয়েক দিনে রাজধানীর তিন হাসপাতালের মর্গে ১০৯ জনের মরদেহের তথ্য পাওয়া গেছে। হাসপাতালের তথ্যে ৮৪ জনের নাম ও বয়স জানা গেলেও সবার পেশার বিষয়ে জানা যায়নি। তবে নিহতদের বেশির ভাগই অছাত্র।
নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে ৬৩ জনের পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে শ্রমিক ৩০ জন, ছাত্র ১৪ জন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ৯ জন, চাকরিজীবী সাতজন এবং ১০ বছরের কম বয়সী শিশু তিনজন। তাদের প্রায় সবাই গুলিতে নিহত হয়। অন্য নিহতদের পরিবারের ফোন বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
১৬ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত সংঘাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে ৮৪ জনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আটজনের নাম-পরিচয় না পাওয়ায় ডিএনএ পরীক্ষা শেষে তাদের মরদেহ আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
অন্য দুই হাসপাতালের মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ১৩ জনের মরদেহ আসে। তারা হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মারা যায়।
এসব মরদেহ কোনো ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনরা নিয়ে যায়। ফলে এদের নাম, বয়স ও পরিচয় জানা যায়নি। এ ছাড়া স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে আসে চারজনের মরদেহ। এর মধ্যে দুজনের মরদেহ স্বজনরা নিয়ে যায়। অন্য দুজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
যে ৮৪ জনের নাম জানা গেছে, তাদের মধ্যে আবার ৯ জনের বয়স জানা যায়নি। বয়সের হিসাব পাওয়া ৭৫ জনের মধ্যে শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সীদের মধ্যে রয়েছে তিনজন। ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে ২৮ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ২২ জন এবং ত্রিশোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা ২২।
নিহত ৩০ শ্রমিকের মধ্যে অন্তত আটজন রিকশা-ভ্যানের চালক। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তিন শিশুশ্রমিকের পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ছাড়া হকার, শাক-সবজির ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকান কর্মচারী ও কেয়ারটেকার হিসেবে পরিচয় দিয়েছে নিহত ১২ জনের পরিবার।
নিহতদের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বেশির ভাগের দাবি, তারা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নয়। কেউ কেউ দাবি করেছে, সংঘাত চলাকালে মাঝখানে পড়ে আকস্মিকভাবে গুলি লেগে নিহত হয়েছে। নিহত তিনজনের পরিবার আন্দোলন অথবা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে।
হাসপাতাল সূত্র মতে, সংঘাতে আহত হয়ে এই সময়ে তিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে অন্তত দুই হাজার মানুষ। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক রোগীকে ভর্তি রেখে জরুরি অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে এক হাজারের বেশি আহত মানুষ। বর্তমানে চিকিৎসাধীন ১৫৯ জন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে পাঁচ শতাধিক আহত মানুষ। মিটফোর্ড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে শতাধিক মানুষ।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান বলেন, সংঘাতের সময় তিন দিন বাসায় যাওয়া হয়নি। দিনরাত মিলিয়ে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। চিকিৎসা নেওয়া পাঁচ শতাধিক রোগীর মধ্যে দেড় শতাধিক মানুষের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। এর মধ্যে ৩০ জনের অস্ত্রোপচার জটিল ছিল। অন্য হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক এনে সার্জারি করাতে হয়েছে। এসব রোগীর ওষুধ কিনতে হয়নি।
মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যে ১৩ জন মারা গেছে, এরা মৃত অবস্থায় হাসপাতালে এসেছে। পরিস্থিতি এমন ছিল যে কোনো ধরনের ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনদের মরদেহ দিতে হয়েছে। না হলে আমি অন্য রোগীদের বাঁচাতে পারতাম না।’
তিন হাসপাতালের একাধিক সূত্র জানায়, ১৯ ও ২০ জুলাই সংঘাতে জরুরি বিভাগে অনেক মরদেহ এলেও সবার ময়নাতদন্ত হয়নি। কারণ এ সময় পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত ছিল যে মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে স্বজনরা কোনো আবেদন ছাড়াই নিজেরাই মরদেহ নিয়ে গেছে।
ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘লাশের ময়নাতদন্তের সিদ্ধান্ত পুলিশ নিয়ে থাকে, এটা তাদের এখতিয়ার। তারা সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে আমাদের কাছে ময়নাতদন্তের জন্য মৃতদেহ পাঠায়। তারা কিছু তথ্য জানতে চায়, যেমন—মৃত্যুর কারণ, কত ঘণ্টা আগে মারা গেছে, হত্যায় কী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ময়নাতদন্ত করে আমরা সেই রিপোর্ট দিয়ে থাকি। এরপর রিপোর্টের ভিত্তিতে পুলিশ তাদের তদন্ত করে। কোর্টে এই রিপোর্ট এভিডেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়।’
মূলত অপঘাতে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয়ে থাকে। ডা. সোহেল মাহমুদ বলেন, ‘অস্বাভাবিক, সন্দেহজনক এবং হঠাৎ মৃত্যু হলে ব্যক্তির পরিচয় ও মৃত্যুর কারণ শনাক্তে ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত করে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি, প্রথমত মৃত্যুর কারণ জানতে পারি। মৃতের পরিচয় জানতে পারি। নেচার অব ডেথ বা মৃত্যুর ধরন জানতে পারি। যেমন—কিভাবে মারা গেছে, কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া হত্যাকারী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, যেমন—হত্যাকারী পেশাদার কি না। ডান হাতে না বাঁ হাতে হত্যা করা হয়েছে।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানার মধ্যে লালবাগ, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীর চর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় কেউ অপঘাতে মারা গেলে ওই লাশের ময়নাতদন্ত হতো স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের মর্গে। বাকি ময়নাতদন্ত হতো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে। এখন ডিএমপির মিরপুর বিভাগের সব থানা, উত্তরা (পূর্ব ও পশ্চিম), তুরাগ, দক্ষিণখান বাড্ডা, ভাটারা থানার মরদেহ যায় শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মর্গে।
শেরেবাংলানগর থানার ওসি মো. আহাদ আলী বলেন, ‘ময়নাতদন্ত ছাড়া কোনো মরদেহ স্বজনরা নিয়ে গেছে—এমন তথ্য আমার জানা নেই। গত সপ্তাহে নিহত ছয়জনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকার দুই হাসপাতালে পাঠিয়েছি।’