কী দোষ ছিল আমার অবুঝ শিশুটির! ও তো এখনো কোটাই বোঝে না, তাহলে ওকে কেন এত কষ্ট নিতে হচ্ছে…’—এমন প্রশ্ন ছিল গুলিতে আহত ৯ বছরের শিশু রিফাতের বাবা সোহাগ হাওলাদারের। অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে শিশুটি। বাম পায়ে ও বাম হাতে গুলির আঘাতের ক্ষত। একটি গুলিই যে ক্ষত তৈরি করে গেছে, তার যন্ত্রণা কোনোভাবেই শিশুটি সইতে পারছে না। সঙ্গে থাকা বাবা-ফুপুর কোনো সান্ত্বনাই শিশুটিকে শান্ত করতে পারছে না।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) সাধারণ ওয়ার্ড-১ (পুরুষ) এর জি-৪৭ নম্বর বিছানায় শুয়ে আছে রিফাত হাওলাদার। শেরেবাংলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাসা মিরপুর-১৩ নম্বরে। বাবা সোহাগ হাওলাদার একজন পাঠাও চালক। তিনি জানান, ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যার পর ছেলে পিঁয়াজু খাওয়ার বায়না ধরে, মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে ৩০০ গজ দূরে একটি দোকানে পিঁয়াজু আনতে বের হয়, দোকান বন্ধ দেখে, রিফাত বাসার দিকে ফিরতে থাকে, পথে অনেক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দেখে সে দ্রুত হাঁটতে শুরু করে, হঠাৎ তার বাম হাতে লেগে বাম পা ভেদ করে বেরিয়ে যায় একটি গুলি। সঙ্গে সঙ্গে সড়কে পড়ে যায় রিফাত। রাতেই তাকে আনা হয় এই হাসপাতালে।
গতকাল রবিবার দুপুরে হাসপাতালের সাধারণ ওয়ার্ড (পুরুষ-১ ও ২) ঘুরে দেখা যায়, সম্প্রতি কোটা আন্দোলনে গুলির আঘাতে আহতদের করুণ আহাজারি। কারো পা কেটে ফেলা হয়েছে, তো কারো পা স্টিলের পাত দিয়ে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। কারো আবার হাত-পা দুটোই ব্যান্ডেজে মোড়ানো, কারো অস্ত্রোপচার হয়ে গেছে, কেউ আবার অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় আছেন। আহতদের অধিকাংশই পথচারী কিংবা সাধারণ স্বল্প আয়ের চাকরিজীবী। কারো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি আহত হওয়ায় শহরের পাট চুকিয়ে চলে যেতে হচ্ছে গ্রামে। কারো ছেলের অঙ্গহানি হওয়ায় কেঁদে কেঁদে দুই চোখ লাল হয়ে আছে।
জি-২৪ নম্বর বেডের শুয়ে আছে ১৮ বছরের রাকিব। তার ডান পায়ের হাঁটুর ওপর থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। তার মা বিনা বেগম বলেন, আমরা অভাবী মানুষ, রাকিব চার মাস ধরে চিটাগাং রোডের হীরাঝিল সেলুনে কাজ শিখছে, ২০ জুলাই কাজ শেষে ফেরার পথে পুলিশের ছোড়া গুলি লাগে, আর ২২ তারিখ পঙ্গু হাসপাতালে তার পা কেটে বাদ দেওয়া হয়। আমার ছেলেটার জীবন এই বয়সে শেষ হয়ে গেল, একটা পা হারাল, এই জীবনের আর কী দাম থাকল!
পাশের বিছানায় ১৬ বছরের কিশোর নাদিম হোসেন, সে কাজ করত একটা এমব্রয়ডারির ছোট কারখানায়। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়ায়। ২০ জুলাই বিকালে কাজ শেষে বাসায় ফেরার সময় পুলিশের গুলি লাগে পায়ে। সোমবার এই হাসপাতালে ভর্তি হলে তার পাও কেটে বাদ দেওয়া হয়।
হাসপাতালের ওই ওয়ার্ডে দায়িত্বে থাকা একজন চিকিৎসক বলেন, আমরা চেষ্টা করি, কোনোভাবেই যেন অঙ্গ বাদ দিতে না হয়। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ইনফেকশন এমন পর্যায়ে যায় যে, আমরা তার জীবন বাঁচাতে অঙ্গ বাদ দিই।
জি-৪৬ নম্বর বেড়ে শুইয়ে আছে ১১ বছরের রবিউল। মিরপুর মডেল একাডেমি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় বাইসাইকেল নিয়ে দোকানে আইসক্রিম কিনতে যায় সে। দোকান বন্ধ দেখে ফিরে আসার সময় একটি গুলি বাম পায়ে ঢুকে ডান পা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। এখন দুই পায়ে ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিতে আছে। পাশে বসে আছেন বড় বোন রুবিনা।
নতুন বাজারে গুলিবিদ্ধ হন মো. সজিব খান (৩২)। তিনি পেশায় একজন প্রাইভেট কার চালক। কাজ শেষ করে বাড্ডায় বাসায় ফিরছিলেন সজিব। তিনি বলেন, পুলিশ আমাদের রাস্তা পার হয়ে যেতে বলেন, আমরা রাস্তা পার হয়ে যাওয়ার তিন থেকে পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় গুলি ছোড়ে। সড়কে কোনো বাতি ছিল না। হাতে গুলি লাগে।
সজিবের স্ত্রী পাখি বেগম বলেন, পাঁচ বছর আগে বরিশাল থেকে ঢাকায় এসেছি। এখন আবার আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে।
জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী শামীম উজজামান বলেন, আমরা সব আহতের যথাসম্ভব চিকিত্সা দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিদিন ২০ থেকে ২১টা অস্ত্রোপচার হয়। জরুরি পরিস্থিতিতে ৪০ থেকে ৫০টি অস্ত্রোপচার করা সম্ভব। এক সপ্তাহ ধরে অস্ত্রোপচারের চাপ বেড়েছে। যাদের অবস্থা বেশি খারাপ তাদের আগে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। গতকালের হিসাব অনুযায়ী আমাদের এই হাসপাতালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় ২৭২ জন আহত এসেছিলেন। তাদের মধ্যে ৭৫ জন এখনো হাসপাতালে আছেন। বাকিরা চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। এর মধ্যে ২৬ জন গুরুতর অসুস্থ।